সুন্দরবনের দুয়ারে ঝড়খালি (Jharkhali - Sundarban)


ডিসেম্বরের শেষ, ঠান্ডাটাও এবারে পড়েছে বেশ জাঁকিয়ে। হওয়ার মধ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে বেশ একটা উৎসব উৎসব মেজাজ। আমাদের অফিসই বা এই মেজাজের ব্যতিক্রম হবে কেন, রব উঠলো একটা পিকনিক করতে হবে। সেই মত শুরু হলো তোড়জোড় আর আলোচনা।

সবার ইচ্ছা একটু নিরিবিলি আর offbit জায়গা। তবে জায়গাটা হতে হবে কোলকাতার কাছাকাছি, যেখানে দিনে দিনে গিয়ে ফিরে আসা যাবে। কারণ আমাদের অনেকজনই আছে যারা বাইরে রাত কাটাতে পারবে না। জায়গা খুঁজতে খুঁজতে আর সকলের পছন্দমত দিন ঠিক করতে করতেই জানুয়ারি মাস কাবার হয়ে গেলো কিন্তু মনের মত জায়গা আর খুঁজে পাওয়া যায় না। অবশেষে বহু আলোচনার পর ঠিক হলো ফেব্রুয়ারির ১১ তারিখ আমরা যাব পিকনিকে। আর জায়গা? জায়গা হলো সুন্দরবনের প্রবেশদ্বার ঝড়খালি।

কোলকাতা থেকে দূরত্ব একটু বেশিই (১০০ কি.মি. এর সামান্য বেশি), কিন্তু একদম ভোরবেলা নিজেদের গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়লে দিনে দিনে ফিরে আসা যেতেই পারে। শুরু হলো তোড়জোড়। প্রথমেই খোঁজ করা হলো মাথা গোঁজার ঠাঁইয়ের। internet ঘেঁটে দেখলাম Royal Sundarban Wild Resort - টি বেশ সুন্দর। ফোন করতে, ওরা বললো আমাদের ১৪ জনের জন্য day booking করে দেবে দুটো কটেজে। আর খাওয়া দাওয়াও ওখানেই। ওদের পাঠানো Bank details অনুযায়ী advance করে booking confirm করা হলো সাথে সাথে। শুধু তাই নয় ওরা whatapp করে আমাদের ওদের মেনু card-ও পাঠিয়ে দিলো যাতে আমাদের এতজনের খাবার ব্যবস্থা ওরা আগে থেকেই করে রাখতে পারে। আমরা সেইমত আমাদের পছন্দের খাবার ওদেরকে জানিয়ে দিলাম। এদিকে বাসের ব্যবস্থাও হয়ে গেলো সাথে সাথে। গত একমাসে যা হচ্ছিলো না দুদিনের মধ্যে সবকিছু confirm হয়ে গেলো।

অবশেষে এলো সেই দিন। আমার pickup point ছিলো সকাল ৬:৩০ মিনিটে exide মোড়ে। সেইমত ভোর ৫টা নাগাদ বেরিয়ে পড়লাম বাড়ি থেকে। তখনো সূর্য্যিমামার ঘুম ভাঙ্গতে বেশ কিছুক্ষণ সময় বাকি আছে। আমার শহরটা আড়মোড়া ভেঙে জেগে উঠতে শুরু করেছে। দু-একটা চায়ের দোকান সবে ঝাঁপ খুলেছে। সেখানে দু একজন প্রাতঃভ্রমণকারীর জটলা। শীতের ভোরের আমেজ নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে একসময় পৌঁছে গেলাম মল্লিকফটকে। হাওড়ার অন্যতম ব্যস্ত এই মোড়টি তখন নিস্তব্ধ। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতেই চলে এলো হাওড়া স্টেশন যাবার বাস। বাসে তখন দশবারো জন যাত্রী। অধিকাংশ যাত্রী চলেছেন ট্রেন ধরতে। পাঁচ মিনিটের মধ্যে পৌঁছে গেলাম হাওড়া স্টেশন। বাস থেকে নামতেই দেখি সামনে একটা মিনিবাস exide যাবে বলে হাঁকছে। উঠে বসে পড়লাম তাতে। বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে একসময় বাস ছাড়লো। তবে ভোরবেলা হওয়াতে যেতে বেশি সময় লাগলো না। সোয়া ছটার মধ্যেই পৌঁছে গেলাম Exide মোড়ে।

Exide মোড়ে পৌঁছে দেখি আমাদের বাস আগেই চলে এসেছে। কিন্তু বাসে উঠে শুনলাম দূর থেকে আসা বেশ কয়েকজন তখনও এসে পৌঁছাতে পারেনি। তাই এখানে আমাদের বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে। অগত্যা রাস্তার পাশে একটা চায়ের দোকান থেকে চা খেয়ে শরীরটা গরম করে নিলাম। আরও বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো সবার আসার জন্য। সবাই আসতে আমরা এগিয়ে চললাম পরবর্তী peekup point শিয়ালদহর জন্য। সবাইকে নিয়ে আমরা যখন শিয়ালদহ ছাড়লাম ঘড়িতে তখন সাড়ে সাতটা বেজে গেছে।



শিয়ালদহ থেকে শুরু করে বেলেঘাটা, বাইপাস হয়ে আমরা এগিয়ে চললাম Science City র দিকে। Science City পার করার পর বাইপাসের বাঁদিকের পাশের রাস্তা ধরে কিছুটা গিয়ে আবার বাঁদিক ঘুরে পরলাম বাসন্তী হাইওয়েতে। পথে বানতলার কাছে দেখি একটা দোকানে গরম গরম লুচি ভাজা হচ্ছে। ভোরবেলা কারোরই কিছু খেয়ে আসা হয়নি। অতএব যাত্রায় সাময়িক বিরতি। গরম গরম লুচি আলুর তরকারি আর জিলিপি দিয়ে বেশ জমে গেলো সকালের জলখাবার। জলখাবার খেয়ে আবার শুরু হলো যাত্রা। কখনো দিগন্ত বিস্তৃত ধানের ক্ষেত কখনো ছোটো গ্রাম আবার কখনো ছোটো শহরের মধ্যে দিয়ে ছুটে চললো আমাদের বাস। ক্যানিং পেরিয়ে কিছুটা যেতে পড়লো মাতলা নদী। এখান থেকেও সুন্দরবন ভ্রমণের লঞ্চ ছাড়ে। মাতলা নদীকে পিছনে ফেলে এগিয়ে চললো আমাদের বাস। দেখতে দেখতে একসময় পৌঁছে গেলাম ঝাড়খালি বাজারে। ঝড়খালি বাজার থেকে আরও কিছুটা এগিয়ে আমাদের রিসর্ট। রিসর্টে পৌঁছতে পৌঁছতে প্রায় বেলা ১২টা বেজে গেলো।


রিসর্টের সামনের রাস্তা


রিসর্টের ভিতরে রিসর্টের ভিতরে
রিসোর্টে ঢুকেই মনটা ভরে গেল। গেটের সামনেই রয়েছে ছোট্ট একটা জলাশয়। জলাশয়ের পাশের রাস্তা দিয়ে এগিয়ে গেলে পরপর সাজানো ছোটো ছোটো কটেজগুলি। কি সুন্দর তাদের নাম আমুদি, পুঁইমাচা, টগরী ... আরও কত কি। সব নামই জঙ্গলের সঙ্গে মিলিয়ে। সারা রিসোর্টটা জুড়ে ফুটে আছে গাঁদা, জবা, চন্দ্রমল্লিকা, মোরগঝুটি আরো কতরকমের ফুল। দেখে চোখ জুড়িয়ে যায়। ক্যামেরা, মোবাইল নিয়ে সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়লো ছবি তুলতে।



রিসর্টের ভিতরে ফুলের বাহার


রিসর্টের ভিতরে ফুলের বাহার রিসর্টের ভিতরে ফুলের বাহার
আমাদের আস্তানা হলো আমুদি ১ ও ২ কটেজে। ঘরে ঢুকে একটু fresh হয়ে নিয়ে বেরিয়ে এলাম রিসর্টটা ঘুরে দেখবো বলে। সোমবার বলেই বোধহয় রিসর্টে আর কোনো অতিথি ছিল না। রিসোর্টের বাগানে শীতের মিঠে কড়া রোদ্দুরে ঘুরতে বেশ ভালোই লাগছিলো। মাঝে এলো গরম গরম চিকেন পকোড়া আর চা। চা পকোড়া খেয়ে বেরিয়ে এলাম রিসর্টের বাইরে। রিসর্টের ঠিক উল্টো দিকেই রয়েছে সুন্দরবনের বিখ্যাত ম্যানগ্রোভ গাছের ঘন জঙ্গল। দেখলাম জঙ্গলের মধ্যে একটা নৌকাও রাখা আছে। তার মানে জোয়ারের সময় ওই পর্যন্ত জল চলে আসে। আসে পাশে কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি আর ছবি তুলে কেটে গেলো আরো বেশ কিছুটা সময়। ইতিমধ্যে ডাক পরলো মধ্যাহ্ন ভোজনের। সবাই এসে জড়ো হলাম রিসর্টের রেস্তোরাঁতে। একে একে সকলের খাবার পরিবেশিত হলো। খাবারের স্বাদ ও পরিমাণ বেশ ভালো।



কাঠ চড়াই  রিসর্টের সামনের ম্যানগ্রোভ অরণ্য 


শ্বাসমূল রজন
দুপুরের খাবার শেষ হতে হতে প্রায় আড়াইটে বেজে গেলো। এরপর আরও কিছুটা সময় গল্পগুজব আর ঘোরাঘুরি করে কাটিয়ে, বিকাল সাড়ে তিনটে নাগাদ আমরা রিসর্ট থেকে check out করে বের হয়ে পড়লাম ঝড়খালি জেটিঘাটের উদ্দেশ্যে। এখান থেকেই বিদ্যাধরী নদীর বুকে ঘুরে বেড়ানোর লঞ্চ ভাড়া করতে হয়। কিন্তু বাস বা গাড়ি কোনোটাই পুরোপুরি জেটিঘাট অব্ধি যায় না। প্রায় এক কিলোমিটার রাস্তা পায়ে হেঁটে যেতে হয় জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে। বড় মনোরম সেই রাস্তা। এখানে রয়েছে ভারতের প্রথম Tiger rescue centre। আর আছে ছোট্ট একটা পার্কও। এই পার্কের মধ্যে একটি পূর্ণ বয়স্ক বাঘকেও রাখা আছে। তবে সময়ের অভাবে আমাদের আর পার্কে ঢোকা হয়ে ওঠেনি। রাস্তা ধরে আমরা এগিয়ে চললাম জেটিঘাটের দিকে। আগেই সাবধান বাণী নজরে এসেছিলো, এবার স্বচক্ষে দেখলাম। বেশ কয়েকটা কয়েকটা মোটাসোটা হৃষ্টপুষ্ট বাঁদর বসে আছে রাস্তার মাঝখানে। জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে একসময় পৌঁছে গেলাম জেটিঘাটে।

জেটিঘাটে পৌঁছে দেখলাম পুরানো জেটি বন্ধ হয়ে গেছে। লঞ্চ booking অফিসের মধ্যে দিয়ে গিয়ে এখন লঞ্চে উঠতে হয়। ঘন্টা হিসাবে লঞ্চ ভাড়া পাওয়া যায় এখানে। আমরা ২ ঘন্টার জন্য একটি লঞ্চ ভাড়া করে, তাতে উঠে পড়লাম। লঞ্চের নিচের দিকে রয়েছে চারটি double বেড কেবিন আর উপরে রয়েছে বসার ডেক। রয়েছে সুন্দর washroom এর ব্যবস্থাও। বসার জন্য ডেকে চিয়ার পাতা রয়েছে অনেকগুলো। আমরা সকলেই উপরের ডেকে উঠে পড়লাম।



জেটিঘাট ঝাড়খালি  লঞ্চের ভিতর শোবার কামরা 

কিছুক্ষণের মধ্যেই লঞ্চ ছেড়ে দিলো। আস্তে আস্তে বনের পাশ দিয়ে এগিয়ে চললো লঞ্চ। সুন্দরী, গড়ান, গেঁওয়া আরও কত জানা অজানা গাছ আর পাখি দেখতে দেখতে এগিয়ে চললাম বিদ্যাধরী নদী মধ্যে দিয়ে। কখনো দেখলাম মাছরাঙ্গা পাখি একনিষ্ট মনে জলের দিকে চেয়ে বসে আছে শিকারের আশায়, কখনো আবার দেখলাম একদল সি-গাল মাছধরা নৌকার পিছু পিছু ধাওয়া করে উড়ে চলেছে। বিদ্যাধরীর ব্যাপ্তি এখানে বিশাল, ভুল হয় সমুদ্র বলে। একুল থেকে ওকুলকে মনে হয় একটা সরু কালো সুতোর মত।










তীরে সবুজের সমারহ আর বিদ্যাধারীর কালচে সবুজ জলে তার প্রতিফলন দেখতে দেখতে কখন যে একঘন্টা কেটে গেলো খেয়ালই করা গেলো না। এখান থেকে লঞ্চ তার মুখ ঘুরিয়ে ফেরার পথ ধরলো। এদিকে সূর্যদেবও তার দিনের পাট চুকিয়ে ঢলে পড়েছেন পশ্চিম দিকে। নদীর জলে আস্তে আস্তে লাগতে শুরু করেছে লালের ছোঁয়া। ঝড়খালিতে লঞ্চের মধ্যে বসে সূর্যডোবার দৃশ্য এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা। প্রকৃতি যে কত রকমের রং দিয়ে নিজেকে সাজাতে পারে তা লিখে বর্ণনা করা সম্ভব নয়। সময় যত এগোতে থাকে, যত সূর্যের আলো কমতে থাকে তত বাড়তে থাকে রঙের বাহার। ক্যামেরায় সে দৃশ্য বন্দী করার চেষ্টা করলাম। কিন্তু ছবিতে যা উঠলো তার থেকেও অনেক সুন্দর সেই দৃশ্য।









একসময় আস্তে আস্তে প্রকৃতির সব আলো ম্লান হয়ে গেলো, নেবে এলো রাত। জ্বলে উঠলো লঞ্চের আলো। আস্তে আস্তে আমাদের লঞ্চ আবার এসে ভিরলো জেটিঘাটে। এবার ফেরার পালা। চাঁদের স্নিগ্ধ আলোকে পাথেয় করে ফিরে চললাম আমাদের বাসের কাছে। দূষণহীন কালো আকাশে তখন মিটমিট করে জ্বলছে সপ্তর্ষি, কালপুরুষ আরো অসংখ্য তারারা সেও এক মনে রাখার মত অভিজ্ঞতা….



========================== কিছু দরকারি কথা =============================

  1. Royal Sundarban Wild Resort এর যোগাযোগ নম্বর 098314 28924
  2. আমাদের দুটি কটেজের মোট ভাড়া পড়েছিলো  প্রায় 4000/- টাকা মত
  3. লঞ্চ ভাড়া ঘন্টায় ৯০০টাকা এবং Permission charge ৬০০টাকা
  4. জঙ্গলে জন্তুজানোয়ার দেখতে পাবার সম্ভাবনা খুবই কম। 
  5. পাখি প্রচুর দেখা যায়। 
  6. শিয়ালদহ থেকে দক্ষিণ শাখার ট্রেন ধরে যেতে হবে ক্যানিং স্টেশন। সেখান থেকে বাস পাওয়া যাবে ঝড়খালি যাওয়ার।

======================================================================




============ সায়ন্তন বসু ============















Comments

Popular posts from this blog

রামরাজাতলা (Ramrajatala - Howrah)

কবিগুরুর দেশে তিনদিন ( পর্ব - ১ ) - বিশ্বভারতী