ইতিহাসের খোঁজে মালদায় ( পর্ব - ১ )
![]() |
আদিনা মসজিদ |
বড়
সুন্দর আমাদের এই বাংলা। একে একদিকে প্রকৃতি যেমন নিজের রূপের ডালি দিয়ে সুন্দর
করে সাজিয়ে তুলেছে অপরদিকে এর রয়েছে গৌরবময় ইতিহাসও। বাংলার এরকমই এক ঐতিহাসিক
স্থান মালদা। প্রাচীন বাংলার বহু ঐতিহাসিক নিদর্শন ছড়িয়ে রয়েছে এই মালদায়।
কথিত
আছে এই স্থানের সূচনা হয় সেই রামায়ণের যুগে। রামচন্দ্রের ভ্রাতা লক্ষণ লক্ষণাবতী
নামে এই নগরীর সূচনা করেন। পরবর্তী কালে বাংলার বিখ্যাত রাজা শশাঙ্কের শাসনকালে এই
স্থান গৌড় নামে পরিচিত হয়। সপ্তদশ শতকে পাল বংশীয় রাজা গোপাল এক সার্বভৌম
নির্বাচনের মাধ্যমে স্বাধীন গৌড়ের রাজা নির্বাচিত হন ও পাল সম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা
করেন। এরপর এখানে সেন বংশের রাজারাও এখানে রাজত্ব করেন। তবে গৌড়ের সবথেকে উত্থান
হয় যখন মুসলিম শাসকরা এখানে রাজত্ব শুরু করেন। প্রায় তিন শতক ধরে মুসলিম শাসকরা
গৌরকে তাদের ক্ষমতার প্রাণকেন্দ্র হিসাবে প্রতিষ্ঠা করেন এবং সাজিয়ে তোলেন ।
পরবর্তী
কালে বাংলার সুলতান তাদের রাজধানী গৌড় থেকে মালদা জেলারই অপর এক স্থান পান্ডুয়াতে
স্থানান্তরিত করেন। এইসময় পাণ্ডুয়াকে নতুন করে সাজানোর জন্য তারা গৌড়ে প্রচুর
লুঠপাট করেন ও গৌড়কে প্রায় ধ্বংস করে ফেলেন।
এই
ইতিহাসকে পরখ করে দেখতে সপরিবারে উঠে বসলাম কলকাতা - হলদিবাড়ি ইন্টারসিটি
এক্সপ্রেসে। সময়টা শরৎকাল সবে পুজো শেষ হয়েছে। বাতাসে হাল্কা শীতের ছোঁয়া।
রেললাইনের ধারে এখানে ওখানে ফুটে রয়েছে কাশফুল। একসময় ভাগীরথী নদী চলতে শুরু করলো
আমাদের সাথে। চলতে চলতে পার করলাম ফারাক্কা ড্যাম্প, ধুলিয়ান যেখানে গঙ্গা
পদ্মা আর ভাগিরথীতে বিভক্ত হয়েছে। প্রকৃতির এই রূপ উপভোগ করতে করতে তিনটে সাড়ে
তিনটে নাগাদ আমরা এসে পৌঁছলাম ওল্ড মালদা স্টেশনে। স্টেশনে নেমে সোজা চলে এলাম
হোটেলে। আজ আর কোথাও নয়। আজ হোটেলেই বিশ্রাম।
পরেরদিন
জলখাবার খেয়ে, একটা
আম্বাসাডর গাড়ি বুক করে বেরিয়ে পড়লাম মালদা দেখতে। মালদা দুটো ভাগে বিভক্ত, পাণ্ডুয়া
আর গৌড়। আমরা ঠিক করলাম আগে পাণ্ডুয়া দেখে নেব। তারপর মধ্যাহ্ন ভোজনের বিরতি দিয়ে
দেখা হবে গৌড়। সেইমত আমাদের গাড়ি ছুটতে শুরু করলো পাণ্ডুয়ার উদ্দেশ্যে।
যেতে
যেতে আমাদের সারথী জানাল, আজ
ঈদ, তাই
অনেক জায়গাতেই আমরা যেতে পারবো না। শুনে মনটা খারাপ হয়ে গেলো। কি আর করা যাবে।
যাইহোক কখনো বিশাল বিশাল আমবাগানের পাশ দিয়ে কখনোবা ছোট ছোট গ্রামের মধ্যে দিয়ে পথ
চলতে চলতে এক সময় আমরা এসে পৌঁছলাম পাণ্ডুয়ার সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ দ্রষ্টব্য
আদিনা মসজিদে।
আদিনা
মসজিদ ভারতীয় উপমহাদেশের সবথেকে বড় মসজিদগুলোর মধ্যে একটি। ইলিয়াস সুলতান সিকান্দর
শাহ ১৩৭৩ সালে এই মসজিদের তৈরি করেন। সম্ভবত দিল্লীর শাসক ফিরোজ শাহ তুঘলকের সঙ্গে
যুদ্ধ জয়ের স্মারক হিসাবে তিনি এই মসজিদ তৈরি করেন। মসজিদের নিচের অংশ কালো পাথরের
তৈরি, আর
উপরের অংশ ইঁটের তৈরি। কথিত আছে কোনো এক হিন্দু মন্দিরকে ভেঙে এই মসজিদ গড়ে উঠে
ছিল। নীচের পাথরের অংশটা মন্দিরের। আর উপরের ইঁটের অংশটা পরে মসজিদ বানানোর সময়
তৈরি করা হয়েছিল। তাই পাথরের অংশটায় বহু হিন্দু দেবদেবীর খোদাই করা মূর্তি দেখতে
পাওয়া যায়।
পাথর ও
ইঁট দুটোর খোদাই কাজ অসাধারণ। বিশেষত থাম আর গম্বুজওয়ালা রাজার বসার জায়গাটা।
ধ্বংসপ্রাপ্ত নামাজ পড়ার বিশাল প্রাঙ্গনটা আজও ইতিহাসকে মনে করিয়ে দেয়। যদিও
মসজিদের বেশিরভাগটাই আজ ধ্বংসপ্রাপ্ত তা হলেও যেটুকু আছে তা দেখেই চোখ জুরিয়ে যায়।
আদিনা মসজিদ দেখতে দেখতে কখন যে সময় পেরিয়ে গেল বুঝতেই পারলাম না। আদিনা মসজিদ
দেখে আমরা আবার গাড়িতে উঠে বসলাম। সারথী বললো পরবর্তী গন্তব্য একলাখি মৌসলেম।
কিন্তু
আমাদের দুর্ভাগ্য মাঝ রাস্তাতেই আমাদের থেমে যেতে হলো। কারণ তখন সেখানে ঈদের নামাজ
শুরু হয়েছে তাই রাস্তা বন্ধ। অগত্যা একলাখি মৌসলেম ও কুতুব শাহী মসজিদ না দেখেই
ফিরে আসতে হলো আমাদের। এদিকে বেলাও হয়েছে অনেকটা আর ক্ষিদেও পেয়েছে জম্পেস। অতএব
বিরতি মধ্যাহ্নভোজের। তারপর শুরু হবে গৌড় দর্শন।
আমাদের
হোটেলেই দুপুরের খাবার শেষ করে আবার বেড়িয়ে পরলাম গৌড়ের উদ্দেশ্যে। মালদার অধিকাংশ
ঐতিহাসিক নিদর্শনই কিন্তু আছে এই গৌড়ে। গৌড় যাবার পথে পরে চৈতন্য মহাপ্রভুর স্মৃতি
বিজড়িত ছোট্ট সুন্দর গ্রাম রামকেলি।
চৈতন্যদেব বৃন্দাবন যাবার পথে এখানে কিছুদিন অবস্থান করেন। এখানে রয়েছে ছোট্ট এক মন্দির। মন্দির ঘিরে রয়েছে দুটি তমাল ও দুটি কদম গাছ। কথিত যাচ্ছে এইস্থানে বসে চৈতন্যদেব ধ্যান করতেন। কিন্তু আমরা যখন পৌঁছলাম দেখি মন্দির বন্ধ। একজন মন্দিরের পাশ দিয়ে একটা রাস্তা দেখিয়ে দিলেন। সেই রাস্তা ধরে একটু এগোতেই আর একটা বড় মন্দির। ভিতরে রাধাকৃষ্ণের মূর্তি। ওই মন্দিরের মধ্যেই পূজারীকে পাওয়া গেল। যত্ন করে আমাদের মন্দিরের ভিতরে নিয়ে গিয়ে পুজো করালেন, মেয়ের হাতে দিলেন অপরাজিতা ফুল।
চৈতন্যদেব বৃন্দাবন যাবার পথে এখানে কিছুদিন অবস্থান করেন। এখানে রয়েছে ছোট্ট এক মন্দির। মন্দির ঘিরে রয়েছে দুটি তমাল ও দুটি কদম গাছ। কথিত যাচ্ছে এইস্থানে বসে চৈতন্যদেব ধ্যান করতেন। কিন্তু আমরা যখন পৌঁছলাম দেখি মন্দির বন্ধ। একজন মন্দিরের পাশ দিয়ে একটা রাস্তা দেখিয়ে দিলেন। সেই রাস্তা ধরে একটু এগোতেই আর একটা বড় মন্দির। ভিতরে রাধাকৃষ্ণের মূর্তি। ওই মন্দিরের মধ্যেই পূজারীকে পাওয়া গেল। যত্ন করে আমাদের মন্দিরের ভিতরে নিয়ে গিয়ে পুজো করালেন, মেয়ের হাতে দিলেন অপরাজিতা ফুল।
তারপর
বাইরে এসে ছোট মন্দিরের দরজা খুলে দিলেন। এখানে একটি শিলার উপর চৈতন্যদেবের
পদচিহ্ন আছে। এখানেও আমরা পূজো দিলাম। গ্রামের সুন্দর পরিবেশে বেশ কিছুক্ষণ কাটিয়ে
আবার উঠে বসলাম আমাদের বাহনে। পরবর্তী গন্তব্য গৌড়....... গৌড়েরগল্পে আসবো ২য় পর্বে
--------------------------
সায়ন্তন বসু
--------------------------
Comments
Post a Comment