ইতিহাসের খোঁজে মালদায় ( পর্ব - ২ )


রামকেলি দর্শনের পর এবার আমরা ছুটে চলেছি মালদার অপর এক জায়গা গৌড় দর্শনের জন্য।

আমাদের গৌড় দর্শন শুরু হলো বড়সোনা মসজিদ দিয়ে। বড়সোনা মসজিদ বা বারদুয়ারী মসজিদ গৌড়ের সবথেকে সুন্দর স্থাপত্যগুলোর মধ্যে একটি। সম্ভবত এই মসজিদে ১২টি প্রবেশদ্বার ছিলো বলে একে বারদুয়ারী মসজিদ বলে। অসংখ্য থামযুক্ত এই মসজিদের মাথায় ৪৪টি গম্বুজ ছিল।  তবে এর মধ্যে মাত্র ১১টি এখনও দেখতে পাওয়া যায় বাকিগুলো সব ধ্বংসপ্রাপ্ত।




সার সার থামের মধ্যে দিয়ে আলো আঁধারীর খেলা দেখার মত।মসজিদের প্রবেশের গেটগুলোও বেশ সুন্দর। বেশ কিছুক্ষণ এখানে কাটিয়ে আমরা এগিয়ে চললাম আমাদের পরবর্তী গন্তব্য় দাখিল দরওয়াজার দিকে।



গৌড়ের ধ্বংস প্রাপ্ত দুর্গের প্রবেশদ্বার ছিল এই বিশালাকার দাখিল দরওয়াজা। একসময় এখান থেকে কামান থেকে তোপ  দেগে সুলতানকে সালামী দেওয়া হত। তাই এই দরজার অপর নাম সালামী দরওয়াজা। এই দরজার ভিতরটা বেশ অন্ধকারাচ্ছন্য আর স্যাঁতস্যাঁতে। দরজা দিয়ে ভিতরে ঢুকলেই দুপাশে ৱয়েছে প্রহরীদের থাকার ঘর। এই দরোয়াজার গায়েও রয়েছে অপূর্ব টেরাকোটার কাজ।



দরজার দুপাসটা উঁচু হয়ে উপরে উঠে গেছে প্রায় দরজার মাথা অব্দি। আমরা ঢাল বেয়ে উপরে উঠে পড়লাম। উপর থেকে আরো বেশ খানিকটা দেখা যায়। যতদূর চোখ যায় চারিদিকে শুধু সবুজ আমবাগান। 

দাখিল দরোয়াজার থেকে এটুদূরেই রয়েছে ফিরোজ মিনার। এই মিনারটি সম্ভবত নির্মাণ করেছিলেন সুলতান সৈফুদ্দিন ফিরোজ। যিনি বারবাক শাহকে হত্যা করে সুলতান হন। প্রায় ২৫ মিটার লম্বা বারোভুজ বিশিষ্ট এই মিনারের ভিতর রয়েছে ৭৩ ধাপ সিঁড়ি, যা দিয়ে মিনারের উপরে পৌঁছানো যায়। যদিও দেখলাম প্রবেশদ্বারে তালা ঝুলছে। অতএব উপরে যাওয়ার আশা ছেড়ে বাইরে থেকেই মিনারের ছবি তুলে সাধ মেটাতে হলো।



ফিরোজ মিনার দেখে আবার চড়ে বসলাম আমাদের বাহনে গন্তব্য চিকা মসজিদে। একে চিকা মসজিদ বলা হলেও আসলে এটি একটি সমাধিস্থল ছিলো বলে মনে করা হয়। আবার শোনা যায় সুলতান হুসেন শাহ এটিকে কারাগার হিসাবে ব্যবহার করতেন। কোনো সময় এই মসজিদের ভিতর অনেক চামচিকের আধিক্য ছিলো। সেই থেকেই এই মসজিদের নাম হয় চিকা মসজিদ।


  
চিকা মসজিদের উল্টোদিকেই দেখলাম আর একটা গম্বুজযুক্ত কিছু একটা রয়েছে।  কাছে গিয়ে পুরাতত্ত্ব বিভাগের বোর্ড থেকে জানলাম স্থাপত্যের নাম গুমতি দরওয়াজা। এই দরওয়াজাও গৌড় দুর্গের এক প্রবেশদ্বার ছিল। সম্ভবত সুলতান হুসেন শাহ এর নির্মাণ করেন। দাখিল দরওয়াজার মত বিশালাকার না হলেও এর কারুকার্যও দেখার মত। আর পাস দিয়েও উঠে যাওয়া যায় দরজার মাথার দিকে। সুন্দর টেরাকোটার কাজ মন ভরিয়ে দিলো।



গুমতি দরওয়াজা দেখে আমরা আবার গাড়িতে উঠলাম। পরের দ্রষ্টব্য কদম রসুল মসজিদ, ফতেহ খানের সমাধী ও লুকোচুরি দরওয়াজা। গাড়ি থেকে নেমে প্রথমেই পরে ফতেহ খানের সমাধীতে।

ফতেহ খান ছিলেন সম্রাট আওরঙ্গজেবের সেনাপতি দিলওয়ার খানের পুত্র। সম্রাট তাকে পীর শাহ নিয়ামতুল্লাকে হত্যা করতে পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু তার আগেই ফতেহ খান রক্ত বমি করতে করতে মারা যান। কুঁড়েঘরের  আদলে তৈরি এই সুন্দর সমাধী দেখলে মন জুড়িয়ে যায়।



ফতেহ খানের সমাধীর ঠিক পাশ দিয়ে একটু এগোলেই রয়েছে কদম রসুল মসজিদ। সুলতান নসরৎ শাহের আমলে তৈরি এই মসজিদে হজরত মহম্মদের পদচিহ্ন রক্ষিত ছিল। মসজিদের গঠনশৈলী ও টেরাকোটার কাজ নজর কাড়ে। বেশ কিছু ছবি তুলে বেরিয়ে এলাম কদম রসুল মসজিদ থেকে। একটু দুরেই আরেটা প্রবেশদ্বারের মত কিছু দেখা যাচ্ছিল। সারথী জানাল ওটাই লুকোচুরি দরওয়াজা।






কদম রসুল মসজিদ থেকে পায়ে পায়ে চলতে থাকলাম লুকোচুরি দরওয়াজা। লুকোচুরি দরওয়াজা, এটিও গৌড় দূর্গের একটি প্রবেশদ্বার ছিল বলে মনে করা হয়। সুলতান তার বেগমদের সঙ্গে এখানে লুকোচুরি খেলতেন। সেই থেকেই এই দরবাজার নাম লুকোচুরি হয়েছে। লুকোচুরি দরওয়াজা দেখে আমরা আবার গাড়িতে উঠে বসলাম আমাদের মালদা ভ্রমণের শেষ গন্তব্য লোটন মসজিদে যাওয়ার জন্য।



লোটন মসজিদের দেওয়ালটি নাকি আগে রঙিন ইঁট দিয়ে আবৃত ছিল। অপূর্ব সুন্দর মসজিদের গায়ের টেরাকোটা কারুকাজ। মনে করা হয় সুলতান ইউসুফ শাহর আমলে এটি তৈরি হয়। 



লোটন মসজিদ দর্শনের সাথে সাথে শেষ হলো আমাদের মালদা দর্শন।  বাংলার সুলতানী যুগের ইতিহাস আর স্তাপত্যকে চাক্ষুস করতে পেরে মন একদম কানায় কানায় পরিপূর্ণ হয়ে উঠলো। তবে একটা কথা এখানে বলা দরকার আমাদের এই গর্বের ইতিহাস কিন্তু দীর্ঘকালীন অবহেলার স্বীকার। অধিকাংশ স্থাপত্যর অবস্থাই খুব খারাপ, আছে সংরক্ষণের অভাব। তবে এখন স্থাপত্যগুলোকে UNESCO হেরিটেজ সাইট হিসাবে ঘোষণা করার পর অবস্থার অনেকটা উন্নতি হয়েছে। 

তবে এই অবহেলার জন্য আমরাও কিছুটা দায়ী। বাংলার ভ্রমণ পিপাসুরা কিন্তু মালদাকে বেশ খানিকটা ব্রাত্যই করে রেখেছে। পুজোর ছুটি বা শীতের ছুটির মত বড় ছুটির দরকার নেই, মাত্র দিন তিনেকের ছুটিতেই ঘুরে আসা যায় মালদা। তাই সপ্তাহান্তে দীঘা, মন্দারমনির সাথে সাথে ঘুরে আসুন মালদা। দেখে আসুন বাংলার গর্বের ইতিহাসকে, পরখ করুন বাংলার নিজস্ব টেরাকোটা শিল্পকে।

--------------------------
সায়ন্তন বসু
--------------------------


Comments

Popular posts from this blog

সুন্দরবনের দুয়ারে ঝড়খালি (Jharkhali - Sundarban)

রামরাজাতলা (Ramrajatala - Howrah)

কবিগুরুর দেশে তিনদিন ( পর্ব - ১ ) - বিশ্বভারতী