পাথরের দেশ দুবরাজপুরে



দুবরাজপুর নামটার সাথে আমার প্রথম পরিচয় সত্যজিৎ রায়ের ফেলুদার মাধ্যমে। 'রবার্টসনের রুবি' গল্পটার কথা মনে পড়ে। সারা গল্পটাই কিন্তু এই জায়গার প্রেক্ষাপটে লেখা। তখন থেকেই মনের মধ্যে 'মামা ভাগ্নে' পাহাড়ের জন্য এক আকর্ষণ সৃষ্টি হয়ে গেছিল বোধহয়।


চাকরি পরিবর্তনের সুবাদে জুন মাসের শেষের দিকে প্রায় এক সপ্তাহ মত একটা ছুটি পাওয়া গিয়েছিল। তা থেকে দিন তিনেকের জন্য বরাদ্দ করলাম সপরিবারে তারা মায়ের কাছে পুজো দিয়ে আসার জন্য। সাথে বক্রেশ্বরটাও ঘুরে আসবো। তখনই মাথায় এলো বক্রেশ্বরের খুব কাছেই তো দুবরাজপুর।


অতএব শুরু হলো internet এ অনুসন্ধান। সব খোঁজাখুঁজি করে দেখলাম, হাওড়া থেকে একমাত্র হুল এক্সপ্রেসই আছে যেটা ভোরবেলা ছেড়ে মোটামুটি সাড়ে দশটা নাগাদ সরাসরি দুবরাজপুর পৌঁছে যায়। তারপর দুবরাজপুর থেকে গাড়ি ভাড়া করে দিনে দিনে মামা ভাগ্নে পাহাড় ও বক্রেশ্বর দেখে তারাপীঠে চলে আসা যায়।


সেইমত এক শনিবার ভোরবেলা আমরা অর্থাৎ বাবা, মা, আমি, আমার অর্ধাঙ্গিনী ও আমার ছোট্ট মেয়ে সবাই মিলে চেপে বসলাম হুল এক্সপ্রেসে। সকালের স্নিগ্ধ আবহাওয়ায় মনেই হচ্ছিল না যে এটা গ্রীষ্মকাল। গরমের মালুমটা হলো ট্রেন থেকে নাবার সময়ে AC থেকে বেরোনোর পর। মনে হলো গরম হওয়াটা যেন আমাদের অভ্যর্থনা করার জন্য অপেক্ষা করে ছিলো। আমরা ট্রেন থেকে নাবতেই সে ঝাঁপিয়ে পড়লো। যাই হোক গরম সম্পর্কে মানসিক প্রস্তুতি নিয়েই এসেছিলাম তার সঙ্গে বেড়ানোর আনন্দে আমাদের ধাতস্থ হতে খুব একটা সময় লাগলো না।




দুবরাজপুর স্টেশনটা কিন্তু একেবারে ছোট্ট একটা স্টেশন। স্টেশন থেকে বেরিয়েই দেখলাম বেশ কিছু গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। তাদের মধ্যে থেকেই একটা মারুতি omni বুক করা হলো যে আমাদের মামা ভাগ্নে পাহাড় ও বক্রেশ্বর দেখিয়ে তারাপীঠ পৌঁছে দেবে। এখানে বলে রাখা দরকার স্টেশন থেকে বেরিয়ে একটু এগোলেই taxi stand আছে। হয়তো সেখানে ভাড়া আরো কিছুটা কম হত। কিন্তু প্রথমবার তাই আমাদের জানা ছিলো না। গাড়ি ছুটতে শুরু করলো পাথর রাজ্য মামা ভাগ্নের দিকে।


আপনারা নিশ্চয়ই ভাবছেন এতক্ষণ ধরে আমি যে এই মামা-ভাগ্নের কথা বলে যাচ্ছি আসলে এরা কি? কি এদের বৈশিষ্ট? বলছি বলছি .... শুনুন তাহলে। 'মামা - ভাগ্নে' আসলে দুটি বিশালাকার পাথরের নাম। পাথরের আবার নাম ! এ আবার কিরকম কথা? হয় হয় পাথরেরও নাম হয়, যদি তারা বিখ্যাত পাথর হয়। মামা ভাগ্নের খ্যাতি balancing rock হিসাবে। balancing rock মানে একটি পাথরের উপর আরেকটি পাথর রয়েছে কিন্তু তাদের intersection area খুব ছোট ও সরু। অথচ ওরা একে অপরের উপর যুগযুগ ধরে দাঁড়িয়ে আছে। কোনো রকম প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেমন ভূমিকম্প বা ঝড় এদের এখনো আলাদা করতে পারেনি। এই পাথুরে মামা ভাগ্নেকে দেখতেই আমরা এখন দুবরাজপুরের ঘিঞ্জি রাস্তার মধ্যে দিয়ে ছুটে চলেছি।




প্রায় একঘন্টা চলার পর আমরা এসে পৌঁছলাম মামা ভাগ্নে পাহাড়ের তলায়। একটা মজার ব্যাপার আসার পথে আর কোথাও কিন্তু এরকম পাহাড় দেখতে পেলাম না। মনে হয় যেন কোন শক্তিমান এসে এখানে একরাশ পাথর ফেলে এই পাহাড়ের সৃষ্টি করেছে। দুবরাজপুরের সাথে জড়িয়ে থাকা পৌরাণিক কাহিনীটাও কিন্তু সেই কথাই বলে। কথিত আছে সেতু বন্ধনের সময় রামচন্দ্র স্বর্গ থেকে এই রাস্তা দিয়েই পাথর নিয়ে যাচ্ছিলেন। কিন্তু এখানে এসে তার পক্ষীরাজ ঘোড়াগুলি ক্লান্ত হয়ে পরে। তাই তিনি এখানে কিছু পাথর ফেলে রেখে যান। আবার ভিন্ন মতে বলে শিব ঠাকুর বিশ্বকর্মা ঠাকুরকে এই স্থানে একরাতের মধ্যে দ্বিতীয় কাশী তৈরি করতে বলেন। কিন্তু বিশ্বকর্মা ঠাকুরের পাথর জোগাড় করতে করতেই ভোর হয়ে যায়। তাই তিনি পাথরগুলি এখানে ফেলে রেখেই অন্তর্হিত হন। সেই থেকেই এখানে পাথরগুলো স্তূপাকার হয়ে এই পাহাড়ের সৃষ্টি করেছে।


গাড়ির রাস্তা পাহাড়ের তলাতেই শেষ। তারপর পাথুরে রাস্তায় বেশ খানিকটা চড়াই উঠে পৌঁছাতে হয় মামা ভাগ্নের কাছে। সারা রাস্তাটা ঢেকে রেখেছে উঁচু উঁচু গাছ। তাই জুনে মাসের দুপুরেও পথ চলতে খুব একটা কষ্ট হলো না। যদিও এখানে মামা ভাগ্নেরই বেশি নামডাক, কিন্তু লক্ষ করলাম সারা জায়গাটাই একটা পাথরের উপর আরেকটা পাথর সাজিয়ে তৈরি হয়েছে। প্রত্যেক পাথর একে অপরের উপর balance করে দাঁড়িয়ে আছে। নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন এরা কিভাবে বছরের পর বছর এইভাবে দাঁড়িয়ে আছে।



পথ চলতে চলতে মাঝে মাঝেই চোখে পড়ছে মাথায় পাতা বা কাঠের বোঝা নিয়ে চলেছে স্থানীয় মানুষজন। তাদের থেকেই পথের হদিস নিয়ে পায়ে পায়ে এগিয়ে চললাম। ঠান্ডা হাওয়া, পাখির ডাক, নির্জনতা আর প্রকৃতির নিজের তৈরি বিশাল বিশাল পাথরের ভাস্কর্য দেখতে দেখতে এক সময় চলে এলাম পাহাড়ের একদম ওপরটাতে। এখানেই রয়েছে আমাদের কাঙ্খিত মামা-ভাগ্নে পাথর।



মাত্র দুটো ছোট ছোটো পাথরের উপর কি করে যে অত বড় একটা পাথর দাঁড়িয়ে আছে তা সত্যি বিস্ময়কর। মামা ভাগ্নের পাস থেকে গোটা জায়গাটার একটা সুন্দর bird's eye view পাওয়া যায়। অপূর্ব সেই দৃশ্য। মন ভরে ছবি তুলে আস্তে আস্তে নাবতে শুরু করলাম। একটা কথা এখানে অবশ্যই বলে রাখা দরকার পাহাড়ে ওঠার রাস্তা প্রায় নেই বললেই চলে। পুরোটাই পাথর টপকে টপকে চলতে হয়। তাই বয়স্ক মানুষদের পক্ষে উপরে ওঠা বা নামা বেশ কষ্টকর।



এই পাহাড়ের পাদদেশে আছে পাহারেশ্বর শিবের বিশালাকার মন্দির। মন্দিরের ভিতর পাহাড়েরই দুটি শিলাকে শিব ও পার্বতীরূপে পূজা করা হয়। পুরোহিত জানালো এই শিলা দুটি নাকি আজও বেড়ে চলেছে আকারে। আমরা পুজো দিয়ে বাইরে এসে গেলাম পাশ্ববর্তী বজরংবলীর মন্দিরে। এখানেও মূর্তি পাহাড়ের একটি শিলা। মন্দির দর্শন শেষ করে কিছুক্ষণ সুশীতল গাছের ছায়ায় বিশ্রাম নিয়ে যাত্রা শুরু হলো বক্রেশ্বরের উদ্যেশ্যে। সে গল্প আরেকদিন হবে।




Comments

Popular posts from this blog

সুন্দরবনের দুয়ারে ঝড়খালি (Jharkhali - Sundarban)

রামরাজাতলা (Ramrajatala - Howrah)

কবিগুরুর দেশে তিনদিন ( পর্ব - ১ ) - বিশ্বভারতী