নবাবের দেশে (মুর্শিদাবাদ) - পর্ব : ১



মুর্শিদাবাদ, এই শহরের পরতে পরতে রয়েছে বাংলার নববীয়ানার ইতিহাস। একদিকে যেমন রয়েছে স্বাধীন বাংলার শেষ নবাব সিরাজদ্দৌলার বীরত্ব, সাহসিকতার এবং হার না মানার উজ্জ্বল কাহিনী আর তার ঠিক বিপরীতে রয়েছে মীরজাফর, জগৎ শেঠদের বিশ্বাসঘাতকতার কলঙ্কিত ইতিহাস। বাংলার এই নববীয়ানাকে ছুঁয়ে দেখতে মালদা থেকে একদম ভোরবেলা বেরিয়ে পড়লাম মুর্শিদাবাদের উদ্দেশ্যে। মালদার কথা তো আগেই বলেছি। এবার বলবো মুর্শিদাবাদের কথা।

মালদার হোটেলে আগেরদিন রাতেই check out করে রাখা ছিল। ভোরবেলা ইন্টারসিটি এক্সপ্রেস ধরতে আমরা যখন বেরোলাম তখন সবে ভোর হচ্ছে। হোটেল থেকে বেরিয়ে একটা গাড়ি পাওয়া গেল যেটা ধরে আমরা নিউ মালদা স্টেশনে পৌঁছে গেলাম। যথা সময় আমরা ট্রেনে চেপে বসলাম। ট্রেন ছুটতে থাকলো নবাবের দেশের দিকে। এক সময় গুমগুম আওয়াজ করতে করতে ফারাক্কা ব্যারেজ পেরিয়ে গেলাম। তারপর এলো ধুলিয়ান স্টেশন। এটা সেই জায়গা যেখানে গঙ্গা, পদ্মা ও ভাগীরথী দুই ধারায় ভাগ হয়ে গেছে। চলতে চলতে একসময় পৌঁছে গেলাম খাগড়াঘাট স্টেশনে। এই স্টেশনটি ভাগীরথীর যে পাশে তার বিপরীত দিকে বহরমপুর শহর। আমরা যাব বহরম ছাড়িয়ে নবাবের খাস জায়গা লালবাগে। স্টেশন থেকে বেরিয়ে একটা অটো ভাড়া করে রওনা দিলাম লালবাগের উদ্দেশ্যে। ভাগীরথী নদীর ব্রীজ, বহরমপুর শহর পেরিয়ে অটো চললো লালবাগের দিকে।

ঔরঙ্গজেবের রাজত্বকালে বাংলার দেওয়ান মুর্শিদকুলি খাঁ, বাংলার রাজধানী বাংলাদেশের ঢাকা থেকে সরিয়ে নিয়ে এসে এখানে স্থাপন করেন এবং এই নিজের নামে এই জায়গার নাম মুর্শিদাবাদ রাখেন। পরবর্তীকালে তিনি বাংলার নবাব হন। এর পরবর্তী সময় বাংলার নবাব হন আলীবর্দী খাঁ। স্বাধীন বাংলার শেষ নবাব সিরাজউদ্দৌলা ছিলেন আলীবর্দী খাঁয়ের পৌত্র। নবাব বংশ ছাড়াও মুর্শিদাবাদে ছিলেন জগৎ শেঠের বংশ। এরা ছিলেন বাংলা তথা ভারতের প্রথম banker ।

সিরাজউদ্দৌলার রাজত্বকালে ব্রিটিশরা কলকাতায় Fort William তৈরি করে এবং সেখানে সেনা প্রশিক্ষণ শুরু করেন। এই খবর পাওয়া মাত্র সিরাজ Fort William আক্রমন করেন ও ইংরেজদের পরাজিত করে দুর্গের দখল নেন। প্রতিশোধ নিতে বদ্ধপরিকর লর্ড ক্লাইভ জগৎ শেঠ ও নবাবের সেনাপতি মীরজাফরের সাথে ষড়যন্ত্র করেন। কলকাতা থেকে ফেরার পথে পলাশীতে ইংরেজরা সিরাজকে আবার আক্রমন করেন। এই যুদ্ধে সিরাজের অন্যতম সেনাপতি মীর মদনের মৃত্যু হয়। এই সময় সিরাজ মীরজাফরকে ডেকে পাঠান সাহায্যের জন্য। কিন্তু মীরজাফর ষড়যন্ত্র করে তাকে আর যুদ্ধ না করে মুর্শিদাবাদ ফিরে যেতে বলেন। মীরজাফরের কথামত নবাব সৈন্য ফিরিয়ে নেন ও মুর্শিদাবাদ ফিরতে থাকেন। কিন্তু ফেরার পথে ব্রিটিশরা তাদের উপর অতর্কিতে আক্রমন করে। ফলে খুব সহজে নবাবের সেনা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। নবাব যুদ্ধে পরাজিত হয়ে যুদ্ধক্ষেত্র ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন। কিন্তু পরবর্তীকালে মীরজাফরের সৈন্যরা নবাবকে বন্দী করে। পরে নবাবকে হত্যা করা হয়।

এই নবাবী ইতিহাসের একমাত্র বর্তমান সাক্ষী ভাগীরথীর পাশ দিয়ে চলতে চলতে আমরা একসময় পৌঁছে গেলাম লালবাগে। লালবাগে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলো আমার এক ছাত্র নবাবের বংশধর সৈফুদ্দিন মির্জা। বড় ভালো ছেলে মীর্জা। আমাদের মুর্শিদাবাদ বেড়ানোর সব ব্যবস্থা ওই করেছিল। শুধু তাই নয় সারাদিন নিজে আমাদের সঙ্গে থেকে সব ঘুরিয়ে দেখিয়েছে। লালবাগে পৌঁছতেই আমাদের আপ্যায়ন করে নিয়ে গেল সাগ্নিক হোটেলে।

আমার মনে হয় হোটেল সাগ্নিক মুর্শিদাবাদের সব থেকে ভালো হোটেলগুলির মধ্যে একটি। ঘরের জানলা খুললেই দেখা যায় ভাগীরথী নদী। আর মিনিট ১৫ হাঁটলেই পৌঁছে যাওয়া যায় হাজারদুয়ারীতে। হোটেলের নিজস্ব রেস্টুরান্টের খাবারও খুব ভালো।

সারাদিনের ট্রেন journey করে আমরা সকলেই খুব ক্লান্ত ছিলাম। তাই তাড়াতড়ি মধ্যাহ্ন ভোজন সেরে সবাই একটু বিছানায় গড়িয়ে নিলাম। তারপর বিকালবেলা হাঁটতে হাঁটতে চলে এলাম হাজারদুয়ারীতে। হাজারদুয়ারীর প্রাঙ্গনটা খুব সুন্দর। চারিদিকে সুন্দর সাজানো বাগান, হাজারদুয়ারীর ঠিক বিপরীতেই রয়েছে এশিয়ার সবথেকে বড় ইমামবড়া। কিন্তু বেশিক্ষণ থাকা গেল না। কারণ রাত্রিবেলা হাজারদুরীর ভিতর থাকার নিয়ম নেই। রাত্তিরের দিকে মির্জা এসে বলে গেল কাল সকাল সকাল তৈরি থাকতে। ও টাঙ্গা ভাড়া নিয়ে চলে আসবে আমাদের মুর্শিদাবাদ দেখাবে বলে।

পরেরদিন জলখাবার খেয়ে সকাল সাড়ে সাতটার সময় তৈরি হয়ে নিলাম। আগেরদিনের কথা মত মির্জা টাঙ্গা ভাড়া করে চলে এলো প্রায় সাথে সাথেই।  আমরা আর সময় নষ্ট না করে বেরিয়ে পড়লাম মুর্শিদাবাদ দর্শনে। মুর্শিদাবাদের রাস্তা দিয়ে ছুটে চললো আমাদের টাঙ্গা। কাটরা মসজিদ দিয়ে শুরু হলো আমাদের মুর্শিদাবাদ দর্শন।

কাটরা মসজিদ, মুর্শিদকুলি খাঁয়ের সমাধি মসজিদ। মসজিদটি বাইরে থেকে দেখতে একটা দুর্গের মত। চারদিকে পাঁচিল দিয়ে ঘেরা চারকোনায় চারটি সুউচ্চ মিনার। দেখে মনেই হয় না এটা একটা মসজিদ। কাছে গিয়ে ভুল ভাঙলো। যেটাকে পাঁচিল ভাবছিলাম সেটা আসলে ছোটো ছোটো দোতলা কুঠুরী ঘর। প্রত্যেক কুঠুরির মাথায় রয়েছে একটি করে গম্বুজ। আগেকারদিনে এই কুঠুরিগুলোতে বসে কোরান পাঠ করা হতো। প্রায় ৭০০ জন একসাথে এখানে বসে কোরান পাঠ করতে পারতেন। আর এই পাঁচিলের চার কোনে রয়েছে চারটি অষ্টভূজ মীনার। মীনারগুলির গায়ে রয়েছে ছোটো ছোটো গর্ত, যা দিয়ে বন্দুক চালানো হতো। 


কাটরা মসজিদ

এই কুঠুরির পাঁচিলের মধ্যে দিয়ে ভিতরে ঢুকলে দেখতে পাওয়া যায় আসল মসজিদটিকে। চৌদ্দ ধাপ সিঁড়ি দিয়ে উঠে মসজিদে প্রবেশ করতে হয়। দেখলাম লোকে সিঁড়ি দিয়ে না উঠে সিঁড়ির বাঁদিকে গিয়ে সিঁড়ির নিচে কিছু দেখছে। আমরাও সেদিকে এগিয়ে গেলাম। দেখি সিঁড়ির নীচে একটি সমাধি। মির্জা বললো ঐটাই  মুর্শিদকুলি খাঁয়ের সমাধি। নবাবের ইচ্ছা অনুযায়ীই নাকি তাকে এরকম জায়গায় সমাধিস্থ করা হয়েছে। তিনি মনে করতেন মৃত্যুর পর তার সমাধির উপর দিয়ে সবাই মসজিদে প্রবেশ করলে তার পাপস্খলন হবে। সমাধি দেখে আমরা সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে প্রবেশ করলাম মসজিদে।


কাটরা মসজিদের ভিতরে কাটরা মসজিদের প্রবেশপথ এরই নীচে
রয়েছে মুর্শিদকুলি খাঁয়ের সমাধি


মসজিদের ভিতরে রয়েছে নামাজ পড়ার বিশাল উন্মুক্ত জায়গা। সেই উন্মক্ত জায়গা তা পেরিয়ে গেলে মূল মসজিদটি। মসজিদের ভিতরে ঢুকে দেখলাম মসজিদের ছাদের একটা অংশ ভেঙে পড়েছে। তবে ভিতরে পাথর খোদাই করে জাফরির কাজ খুব সুন্দর। 

মসজিদ দেখে যখন বেরোলাম দেখি প্রায় একঘন্টা সময় কেটে গেছে। জল তেষ্টাও পেয়েছে বেশ। দেখি এক ডাবওয়ালা বসে আছে ডাব নিয়ে। সবাই ডাবের জল খেয়ে তেষ্টা মিটিয়ে চেপে বসলাম টাঙ্গায় এবার যাবো মুর্শিদকুলি খাঁয়ের কন্যা আজিমুন্নিসার সমাধি দেখতে। 

আজিমুন্নিসার সমাধি

টাঙ্গা থেকে নেমে দেখি কোথায় মসজিদ। একটা সাজানো বাগান আর দূরে একপাশে দাঁড়িয়ে আছে মসজিদের সামান্য একটা অংশ। সারা মসজিদটি ধ্বংসপ্রাপ্ত শুধু অস্থিত্বের প্রমাণ হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে ওইটুকু অংশ। এই সমাধি মসজিদটির অলঙ্করণ ও গঠণশৈলী নাকি কাটরা মসজিদের মতই ছিল কিন্তু তা আর এখন বোঝার উপায় নেই। পিতার মত ইনার সমাধিও সিঁড়ির তলায়। 

আজিমুন্নিসার সমাধিতে দেখার মত কিছুই আর অবশিষ্ট নেই তাই আমরা এখানে আর বেশি সময় নষ্ট না করে উঠে বসলাম টাঙ্গাতে। এবারে আমরা যাব কাঠগোলা প্রাসাদে।

মুর্শিদাবাদে হাজারদুয়ারীর পরেই স্থান পায় কাঠগোলা প্রাসাদ। লক্ষীপাত সিং দুগার এই প্রাসাদের নির্মাণ করেন। পলাশীর যুদ্ধের পর এখানে মীর জাফর ও ব্রিটিশদের মধ্যে বিভিন্ন অর্থনৈতিক আদান প্রদান হয়।

কাঠগোলা প্রাসাদের প্রবেশপথ কাঠগোলা প্রাসাদ

কাঠগোলা প্রাসাদ মুর্শিদাবাদের সবথেকে সুন্দর স্থাপত্যগুলির একটি। প্রাসাদ ও প্রাসাদ চত্বর দুটিই বিশাল জায়গা নিয়ে। সারা জায়গাটা সুন্দর বাগানে ঘেরা। বেশ খানিকটা এই বাগানের মধ্য দিয়ে হেঁটে প্রবেশ করতে হয় প্রাসাদ চত্বরে। 




প্রাসাদ চত্বরে ঢুকে চোখ জুড়িয়ে গেল। সারা চত্বরটা সুন্দরভাবে সাজানো। উজ্জ্বল হলুদ আর সাদা রঙের প্রাসাদ। তার সামনেই বিশাল এক জলাশয়। প্রাসাদের পাশে সাজানো আছে চা পানের জন্য সে আমলের চেয়ার টেবিল। আর সারা প্রাসাদের আনাচে কানাচে রয়েছে সুন্দর সুন্দর শ্বেতপাথরের তৈরি মূর্তি।



প্রাসাদ প্রাঙ্গনে প্রবেশ করেই দেখি বাঁদিকে একটি সুড়ঙ্গ পথের মুখ। মির্জা বললো এই সুরঙ্গটি জগৎ শেঠের বাড়ি ও ভাগীরথী নদীর সাথে যুক্ত ছিল। এই সুড়ঙ্গ পথেই চলতো ব্যাবসা ও গোপন শলাপরামর্শ। তবে এখন ভাগীরথীর জল ঢুকে সুরঙ্গটি বন্ধ হয়ে গেছে। আর আছে ব্যক্তিগত চিড়িয়াখানার ধংসাবশেষ। 


কাঠগোলা প্রাসাদে - সেই সুরঙ্গপথের মুখ কাঠগোলা প্রাসাদের ব্যক্তিগত চিড়িয়াখানা

চারতলা এই প্রাসাদ এখন সংগ্ৰহশালা। ঢুকে পড়লাম সংগ্ৰহশালা দেখতে। সংগ্রহশালার মধ্যে সংরক্ষিত আছে তদানীন্তন সময়ের বিভিন্ন আসবাবপত্র, তৈলচিত্র, মূর্তি আরো অনেক কিছু।

সংগ্রহশালা দেখে বেড়িয়ে এসে আমরা এগিয়ে বললাম বাগানের পথ দিয়ে। একে একে দেখতে থাকলাম নৃত্যমঞ্চ, শিব মন্দির, সংকট মোচন মন্দির আরো অনেক হিন্দু মন্দির এবং স্থাপত্য।

গনেশ মন্দির বজরংবলী মন্দির

এইভাবে আরো কিছুটা এগোতে সামনে এলো আদিনাথ জৈন মন্দির। অপূর্ব সুন্দর এই মন্দিরের বর্ণনা লেখা দিয়ে সম্ভব নয়। পাথরের কাজ দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়। 



জৈন মন্দির

কাঠগোলা প্রাসাদ দেখে যখন বেরোলাম ঘড়িতে প্রায় দশটা। এবার আমাদের গন্তব্য জগৎ শেঠের বাড়ি। 

জগৎ শেঠের কথা আগেই বলেছি। মুর্শিদাবাদে নবাবদের পরেই স্থান ছিল এই পরিবারের। তাই মুর্শিবাদের অন্যতম সম্ভ্রান্ত পরিবার ছিল এই শেঠদের পরিবার। তার প্রতিফলন এই বাড়িতে প্রবেশ করলেই পাওয়া যায়। 



এই বাড়িটিওকেও এখন এক সংগ্ৰহশালা করে রাখা হয়েছে। এই বাড়িতেও ছড়িয়ে রয়েছে বিভিদ সুন্দর সুন্দর পাথরের মূর্তি, ফোয়ারা। সংগ্ৰহশালায় রয়েছে জগৎ শেঠের ব্যবহৃত বিভিন্ন জিনিস, বাসনপত্র, ছবি। আর বাড়ির বাইরে রয়েছে সেই সুড়ঙ্গের আরেকটি মুখ যেটা আমরা কাঠগোলা প্রাসাদে দেখেছিলাম। জগৎ শেঠের বাড়ি দেখে বেরিয়ে আবার উঠে বসলাম টাঙ্গায় পরবর্তী গন্তব্যের উদ্দ্যেশ্যে। 


জগত শেঠের বাড়িতে - সেই সুরঙ্গপথের মুখ


কিন্তু সে কথা আর আজ নয়। আবার ফিরে আসবো পরের পর্বে।

---------------------------------
সায়ন্তন বসু
---------------------------------

Comments

Popular posts from this blog

সুন্দরবনের দুয়ারে ঝড়খালি (Jharkhali - Sundarban)

রামরাজাতলা (Ramrajatala - Howrah)

কবিগুরুর দেশে তিনদিন ( পর্ব - ১ ) - বিশ্বভারতী