নবাবের দেশে (মুর্শিদাবাদ) - পর্ব : ২
আগের পর্বে (নবাবের দেশে (মুর্শিদাবাদ) - পর্ব : ১) আমরা শেষ করেছিলাম জগৎ সেথের বাড়ি দেখে। এবার আমাদের নিয়ে টাঙ্গা ছুটলো জাফর গঞ্জ সমাধির উদ্দেশ্যে। চলতে চলতে পথে দেখলাম এক বিশাল বড় ভগ্নপ্রায় দরজা। আমাদের টাঙাওয়ালা জানালো এই দরজার নাম নিমক হারাম দেউড়ি। এই সেই জায়গা যেখানে সিরাজকে হত্যা করা হয়েছিল।
![]() |
জাফরগঞ্জ সমাধিক্ষেত্র |
পথ চলতে চলতে একসময় আমরা এসে পৌঁছলাম জাফরগঞ্জ সমাধিক্ষেত্রে। মীরজাফরসহ তার বংশের আরও অনেক নবাব এবং তাদের আত্মীয়রা শায়িত আছেন এখানে।
![]() |
মীরজাফরের সমাধি |
জাফরগঞ্জ সমাধিক্ষেত্র থেকে বেরিয়ে আমাদের পরবর্তী দ্রষ্টব্য ছিল নশীপুর রাজবাড়ি। কিন্তু আমাদের সারথী বললো তার আগে ও আমাদের আর একটা জায়গায় নিয়ে যেতে চায় যেখানে নাকি সাধারণত কেউ নিয়ে যায় না। জায়গাটা হলো নশিপুর বৈষ্ণব আখড়া। আমরা এককথায় রাজি হয়ে গেলাম ওর সাথে যেতে। সাথে সাথে ও টাঙ্গা ছুটিয়ে দিলো আখড়ার উদ্দেশ্যে।
![]() | ![]() |
সোনার রথ | ৮০ টাকার গাড়ি |
এখানে এসে মনে হলো যদি না আসতাম সত্যি অনেক কিছু miss করতাম। বৈষ্ণব এই আখড়া হলেও এটা একটা ছোটোখাটো সংগ্রহশালা। এখানে আছে সোনার পাতে মোড়া রথ, বহু পুরানো সময়ের বাসনপত্র, ৮০টাকা দামের গাড়ি আরও কত কিছু। কিন্তু সবই রয়েছে বড় অনাদরে। কারণ এখানে কেউ আসে না। তাই নেই এর কদরও। পরিচর্চার অভাবে আজ সবকিছুর অবস্থা খুবই সঙ্গীন। সত্যি আমাদের এই উদাসীনতা কিভাবে ধ্বংস করে দিচ্ছে আমাদের গরিমাময় অতীতকে।
শুধু বাইরের সংগ্রহশালা নয়, আখড়ার মূল মন্দিরে প্রবেশ করে চোখ ধাঁধিয়ে গেল ভিতরের অলংকরণ আর সাজসজ্জা দেখে। এত রঙ্গীন আর সুন্দর মন্দির আমি খুব কমই দেখেছি। তবে ভিতরে আলোর যথেষ্ট অভাব আছে। আলোর পরিমাণ ঠিক থাকলে মন্দিরটি আরও সুন্দর হয়ে উঠতো।
আখড়া থেকে বেড়িয়ে আমরা এবার চললাম নশিপুর রাজবাড়ির উদ্দেশ্যে। হাজারদুয়ারীর অনুকরণে 1900 সালে কীর্তি চন্দ্র সিংহ এই প্রাসাদ তৈরি করেন। যত্ন ও পরিচর্চার অভাবে জীর্ণ এই প্রাসাদটিও।
![]() |
![]() |
নশিপুর রাজবাড়ি | নাটমন্দির - নশিপুর রাজবাড়ি |
এই প্রাসাদের সংগ্রহশালাও যথেষ্ট সমৃদ্ধ। এখানে আছে পুরনো গ্রন্থাগার, আর্ট গ্যালারী, আর বিভিন্ন স্থাপত্য। রয়েছে সুদূর রাজস্থান থেকে আনা মার্বেলের জাফরির কাজ। আর সারা বাড়ি জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে বহু হিন্দু দেবদেবীর মূর্তি। তাই একে ঠাকুরবাড়িও বলে অনেকে। কিন্তু পরিচর্চার অভাবে আজ সবই মলীন।
নশিপুর রাজবাড়ি দর্শনের সাথে সাথে সাঙ্গ হলো আমাদের আজকের মুর্শিদাবাদ দর্শন। টাঙ্গা ফিরে চললো হোটেলের দিকে। পথে মির্জা নেবে পড়লো। আর বলে গেল পরের দিন দুপুরবেলা তৈরি থাকতে ও এসে নিয়ে যাবে হাজার দুয়ারী দেখাতে।
ঘড়িতে দেখলাম বেলা অনেকটাই গড়িয়েছে। আর ক্ষিদেও পেয়েছে খুব। হোটেলে ফিরে মধ্যাহ্ন ভোজন শেষ করতে করতে বিকাল হয়ে গেলো। আজ আর কোথাও নয় সারাদিনের ঘোরাঘুরিতে সবাই বেশ ক্লান্ত।
পরের দিন আমরা দুপুরের খাওয়া শেষ করে মির্জার সাথে বেরিয়ে পড়লাম হাজার দুয়ারী দেখতে। আগেই বলেছি আমাদের হোটেল থেকে হাজার দুয়ারী পায়ে হাঁটা পথ। তাই হাঁটতে হাঁটতেই এগিয়ে চললাম হাজার দুয়ারীর দিকে।
আজ যেখানে হাজার দুয়ারী, আগে সেখানে ছিল মুর্শিদ কুলি খাঁ নির্মিত নিজামত কিলা। পলাশীর যুদ্ধের পর ব্রিটিশ অফিসারদের মুর্শিদাবাদে স্থায়ীভাবে থাকার প্রয়োজনীয়তা বাড়তে থাকে। এছাড়া নবাবদের সাথে বিভিন্ন বৈষয়িক ও অফিসিয়াল লেনদেনের জন্য একটি অফিসেরও প্রয়োজনীয়তা বাড়তে থাকে। তাই ডানকান ম্যাকলয়েড সাহেব নিজামত কিলা ভেঙ্গে হাজার দুয়ারী প্রাসাদের নির্মাণ করেন।
হাজার দুয়ারী এরপর থেকে ব্যবহার হত নবাব ও ব্রিটিশদের বিভিন্ন সরকারি কাজের জন্য ও উচ্চপদস্থ ব্রিটিশ কর্মচারীদের থাকার জন্য। তাই প্রথমে এই প্রাসাদকে বড়কুঠি নামে ডাকা হত। পরে এই প্রাসাদের নাম হয় হাজার দুয়ারী। কারণ এই প্রাসাদের চার ধারে রয়েছে ১০০০ টি দরজা। যদিও এই হাজারটি দরজার মধ্যে ১০০টি দরজা কিন্তু আসল নয়। এগুলি শত্রুকে বিভ্রান্ত করার জন্য তৈরি হয়েছিল।
মির্জার কাছে এইসব ইতিহাস শুনতে শুনতে আমরা একসময় পৌঁছে গেলাম হাজার দুয়ারী প্রাঙ্গনে। আগের পর্বেই বলেছি এক বিশাল জায়গা নিয়ে তৈরি হয়েছে এই হাজার দুয়ারী প্রাঙ্গন। এখানে মুখোমুখি রয়েছে হাজার দুয়ারী ও নিয়ামত ইমামবাড়া। এদের মাঝখানে রয়েছে ঘড়িস্তম্ভ, মদিনা মসজিদ, বাচ্চাওয়ালি কামান।
হাজার দুয়ারী স্থাপত্যটার মধ্যেই মনে হয় যেন একটা রাজকীয়তা লুকিয়ে আছে। বিশাল বিশাল থাম, মূল প্রবেশদ্বারের সামনের ৩৭ ধাপ সিঁড়ি সবকিছুর মধ্যেই যেন দৃপ্ত হয় রাজকীয় গরিমা। সারা প্রাসাদটি জুড়ে রয়েছে এক বিশাল সংগ্রহশালা। পরে জেনেছিলাম Archaeological survey of india র সবথেকে বড় সংগ্রহশালা এটি। টিকিট কেটে ঢুকে পড়লাম সেখানে। রয়েছে নবাবদের ব্যবহৃত বিভিন্ন জিনিস, ছবি, অস্ত্রশস্ত্র, আসবাবপত্র আরও বহু জিনিস। তিনতলা এই প্রাসাদের এই সংগ্রহশালা দেখে যখন বেরোলাম তখন বিকাল হয়ে গেছে।
আমরা আস্তে আস্তে এগিয়ে চললাম বিপরীত দিকের ইমামবাড়ার দিকে। বাংলা তথা ভারতের সর্ববৃহৎ ইমামবাড়া এই নিজামত ইমামবাড়া। ১৮৪২ সালে নবাব সিরাজউদ্দৌলা এই ইমামবাড়া নির্মাণ করেন। কিন্তু ১৮৪৬ সালে এক বিধ্বংসী আগুনে অধিকাংশটা কাঠ দিয়ে তৈরি এই ইমামবাড়াটি ভস্মীভূত হয়ে যায়। বেঁচে থাকে শুধু পুরানো মদিনা মসজিদটি।
এরপর ১৮৪৭ সালে নবাব মনসুর আলী খান এই ইমামবাড়া আবার পুনর্নির্মাণ করেন। মক্কা থেকে মাটি এনে রাখা হয়েছে এই ইমামবাড়াতে যাতে দরিদ্র মুসলমানরাও এখানে নামাজ পরে মক্কার সমান পুণ্য লাভ করতে পারেন।
ইমামবাড়া দেখে যখন বাইরে বেরিয়ে এলাম তখন বাইরে শেষ বিকালের আলো। পায়ে পায়ে এগিয়ে গেলাম clock tower এর দিকে। সুন্দর কারুকার্য করা এই ঘড়ি স্তম্ভ। ঘড়ি স্তম্ভের ঠিক বিপরীত দিকেই রয়েছে শ্বেতশুভ্র মদিনা মসজিদ। দিনের শেষ আলোয় মদিনাকে তখন আরও সুন্দর।
মদিনার একটু দূরেই রয়েছে একটি কামান। মির্জা বললো এটি পূর্বতন কেল্লার কামান। এর নাম বাচ্ছাওয়ালি কামান। কারণ এই কামানের শব্দে নাকি গর্ভবতী মায়েদের সন্তান প্রসব হয়ে যেত।
মদিনা মসজিদের আরও একটু পিছনে রয়েছে চক মসজিদ। সন্ধ্যার আলো আঁধারীতে সারা জায়গাটা যেন হয়ে উঠেছে মোহময়। আরও কিছুক্ষন কাটিয়ে বেরিয়ে এলাম হাজার দুয়ারী থেকে।
শেষ হলো বাংলার ইতিহাসকে চাক্ষুষ করা।
==============================
সায়ন্তন বসু
==============================
Comments
Post a Comment