কবিগুরুর দেশে তিনদিন ( পর্ব - ১ ) - বিশ্বভারতী



চারটে পুচকে আর তাদের বাবা মা এই নিয়ে আমাদের ছোট্ট মজাদার গ্রুপ হাঁউ মাঁউ খাঁউ। এই গ্রুপের সদস্যরা যেমন মজাদার তেমনি হুজুগে। এই বাই উঠলো তো সবাই মিলে বসে পড়লো কারোর বাড়িতে আড্ডা মারতে, কখনো বা দলবেঁধে বেরিয়ে পড়লো ঘুরতে। জানুয়ারী মাসের শেষের দিকে এরকমই এক সান্ধ্য আড্ডার আসরে রব উঠলো শীত শেষ হবার আগেই কোথাও একটা যেতে হবে।

যেতে তো হবে কিন্তু জায়গা? এমনিতেই এবারে শীত পড়েছে জাঁকিয়ে তারপর অধিকাংশ স্কুলের পরীক্ষা শেষ। সব জায়গাতেই এখন ভ্রমণপিপাসুদের ভিড়। এত তাড়াতাড়ি কোথায় যাওয়া যায়। অবশেষে সবাই মিলে ঠিক করলাম এবার আমরা যাবো রবি ঠাকুরের দেশ শান্তিনিকেতনে। কিন্তু এতো অল্প সময়ের মধ্যে যেখানেই খোঁজ করি সেখানেই বলে ঠাঁই নাই ঠাঁই নাই।  অবশেষে আমাদের মুশকিল আসান সন্দীপদা মাঠে নেবে পড়লো। আর দুদিনের মধ্যেই প্রান্তিক স্টেশনের কাছে 'নিরিবিলি গেস্ট হাউসে' ফেব্রুয়ারীর ২২ ও ২৩ তারিখ চারটে ঘরের ব্যবস্থা করে ফেললো। ঠিক হলো ২২ তারিখ সকাল সকাল হোটেলে পৌঁছে যাব আমরা। তারপর ২২, ২৩ পুরো দিন থেকে ২৪ তারিখ সকালে lunch করে দুপুরের দিকে কোনো ট্রেনে ফেরা। সাথে সাথে হোটেল মালিকের Account এ টাকা advance করে booking confirm করে নেওয়া হলো। আর plan মত গণদেবতা এক্সপ্রেসে (সকাল ৬ টা ৫ মিনিটে হাওড়া থেকে ছেড়ে ৯টা নাগাদ প্রান্তিক স্টেশনে পৌঁছয়) যাওয়ার টিকিট আর কবিগুরু এক্সপ্রেসে ( দুপুর  ১টা ৫০ মিনিটে প্রান্তিক থেকে ছেড়ে বিকাল ৫ টা  নাগাদ প্রান্তিক স্টেশনে পৌঁছয়) ফেরার টিকিট রিজার্ভ করে নেওয়া হলো। এবার শুরু হলো অপেক্ষা। দিন যেন আর কাটতে চায় না।

অবশেষে এলো সেই দিন। ভোরের journey সবসময়ই আমার খুব পছন্দের। এই একটা সময় যখন আমার অত্যন্ত পরিচিত শহরটাও যেন এক মায়াময়ী রূপ ধারণ করে থাকে। ঠিক পৌনে পাঁচটা নাগাদ আমরা বেরিয়ে পড়লাম হাওড়া স্টেশনের উদ্দেশ্যে। কিছুদূর গিয়ে কালিবাবুর বাজারে সন্দীপদাদের সাথে meet করে নিলাম। পায়ে হেঁটেই এগিয়ে চললাম মল্লিকফটকের দিকে। ঘড়িতে প্রায় ৫টা কিন্তু তখনও রাতের অন্ধকার চারিদিকে। মল্লিকফটক পৌঁছাতেই হাওড়ার বাস পেয়ে গেলাম।  মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম হাওড়া স্টেশনে। কিছুক্ষনের মধ্যেই ধ্রুব আর অর্পণরাও চলে এলো। সবাই মিলে চেপে বসলাম আমাদের নির্ধারিত করা sit এ। ট্রেনও ছেড়ে দিলো একদম ঠিক সময়।

গল্পগুজব আর হইহই করে তিনঘন্টা কোথা দিয়ে কেটে গেলো বোঝাই গেল না। একসময় ট্রেন এসে থামলো বোলপুর স্টেশনে। শান্তিনিকেতনে ঘুরতে আসা অধিকাংশ যাত্রীই এখানে নেবে গেলেন। আমরা যাবো আরো কিছু দূর ... পরের স্টেশন প্রান্তিকে। প্রান্তিক স্টেশনটা বোলপুর স্টেশনের তুলনায় অনেক ছোটো এবং ফাঁকা। তাই পরিষ্কার পরিচ্ছন্নও। ট্রেন থেকে শুধু আমরাই নাবলাম। আমাদের রেখে ট্রেন আবার ছুটতে শুরু করলো তার পরের গন্তব্যের দিকে। ট্রেনটা চলে যেতেই সারা স্টেশনটা আবার শান্ত হয়ে গেলো। শুধু আমাদের কথাবলার আওয়াজ আর পাখপাখালির ডাক ছাড়া নেই কোনো শব্দ ... নেই কোনো ব্যস্ততা। সারাটা স্টেশন ঘিরে আছে বড় বড় গাছ। প্রকৃতি সগর্বে আমন্ত্রণ জানালো তার আপন রাজ্যে।



আগেই জেনেছিলাম আমাদের গেস্ট হাউসটা প্রান্তিক স্টেশনের থেকে পায়ে হেঁটে ১০ মিনিট। তাই স্টেশন থেকে বেরিয়ে একটা টোটোতে মেয়েদের আর বাচ্ছাদের পাঠিয়ে আমরা পায়ে হেঁটে এগিয়ে চললাম আমাদের গেস্ট হাউসের দিকে। সত্যিই ১০ মিনিটেরই দূরত্ব। গেস্ট হাউসের বাইরে আমাদের জন্য care taker মাতু দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিলো। আমরা পোঁছতেই আমাদের অভ্যর্থনা করে ভিতরে নিয়ে গেলো। বড় ভালো ছেলে মাতু। তিনদিন ধরে আমরা যখন যা বলেছি হাসি মুখে তাই করে দিয়েছে।


আমাদের রিসর্ট 'নিরিবিলি গেস্ট হাউস'


রিসর্টের বাগানের ফুল
রিসর্টের বাগানের বাঁধাকপি চাষ

মেন গেট দিয়ে ঢুকে সামনে বেশ বড়মাপের একটা বাগান। সেখানে ফুটে আছে বাহারি ফুল। একপাশে চাষ করা হয়েছে বাঁধাকপি, ফুলকপি, টমেটো, গাজর আরো কতকি। বাগানের শেষে গেস্টহাউসটা। বাড়ির ভিতর ঢুকেই একটা বড় dinning হল তার দুদিকে দুটো ঘর। আর উপরে আরো দুটি শোবার ঘর ও বিশালাকার একটা ছাদ। মোট চারটিই ঘর আছে গেস্টহাউসে। অর্থাৎ এই আড়াই দিনের জন্য এই পুরো গেস্টহাউসটাতে শুধু আমরাই রাজ করবো। প্রথম দর্শনেই সকলেরই বেশ ভালো লেগে গেলো জায়গাটা। বাচ্ছাদের তো খুশির শেষ নেই অত বড় বাগান ... দোলনা ... আর কি চাই ওদের। হইহই করে নেবে পড়লো খেলতে।

একটু গুছিয়ে নিতেই মালুম পড়লো সকাল থেকে পেটে কিছু পরেনি সেইভাবে। অগত্যা আমরা কয়েকজন বেরিয়ে পড়লাম জলখাবারের খোঁজে। কিন্তু মুশকিল হলো এই গেস্টহাউসে বা এর আশপাশে কোনো রেস্টুরেন্ট নেই। তবে গেস্টহাউসে রান্না করার সুন্দর বন্দোবস্ত আছে। নিজেরা বাজার করে রান্না করা যায় বা মাতুকে টাকা দিয়ে দিলে ও বাজার করে এনে দিতে পারে বা রান্নাও করে দিতে পারে। কিন্তু এই জলখাবার বানানোর সময় বা ইচ্ছা কোনোটাই তখন কারোর ছিল না।

রিসর্ট থেকে বেরিয়ে স্টেশনের দিকে একটু এগোতে দেখলাম একটা দোকানে ছাতুর কচুরি ভাজছে। আর আমাদের পায় কে? ওখানেই দাঁড়িয়ে খেয়ে নিলাম। বাকিদের জন্য pack করে ফিরে এলাম রিসর্টে। এরপর মাতুকে পাঠিয়ে দেওয়া হলো বাজারে দুপুরের খাবারের জন্য বাজার করতে। এখানে দুজনের স্ট্যামিনাকে কুর্নিশ না জানিয়ে পারা যায় না। তারা হচ্ছে সন্দীপদা আর মঞ্জুরী। সেই ভোরবেলা উঠে আমরা সবাই যখন একটু গড়িয়ে নেবার plan করছি, সেই সময় ওরা দুজন লেগে পড়লো দুপরের খাবার রান্না করতে। ফলস্বরূপ দুপুর ১টার মধ্যে গরম গরম ভাত, ডাল, পোস্তর বড়া, ডিমভাজা দিয়ে এক অসাধারণ lunch পেয়ে গেলাম আমরা।

lunch করেই সবাই তৈরি হয়ে নিলাম বেরোনোর জন্য - পরবর্তী প্রোগ্রাম বিশ্বভারতী দর্শন। বেরোতে বেরোতে প্রায় সাড়ে তিনটে বেজে গেলো। দুটো টোটো ভাড়া করে, আমরা চলে আসলাম বিশ্বভারতী প্রাঙ্গনে। সাড়ে চারটের সময় রবীন্দ্রভবন museum বন্ধ হয়ে যায়। তাই বিশ্বভারতীতে না গিয়ে আগে রবীন্দ্র মিউজিয়ামে ঢুকে পড়লাম। এখানে বড়দের ও বাচ্ছাদের জন্য টিকিট লাগে। দোতালা এই মিউজিয়ামের উপরতলায় রয়েছে সংগ্রহশালা। আর নীচের তলায় ছবির প্রদর্শনী। সংগ্রহশালার মূল আকর্ষণ রবীন্দ্রনাথের পাওয়া নোবেল পুরস্কার ও শংসাপত্র। যদিও আসলটি চুরি হয়ে যাওয়ায় এখন সেটার replica রাখা আছে। এছাড়াও রয়েছে রবি ঠাকুরের নিজের হাতে লেখা বহু নথি ও আঁকা ছবি। রয়েছে তাঁর ব্যবহার করা বিবিধ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস। উপরতলার মিউজিয়াম দেখা শেষ করে আমরা চলে এলাম নীচের তলার ছবির প্রদর্শনী দেখতে। প্রদর্শনীর প্রবেশের মুখেই রয়েছে রবীন্দ্রনাথকে বাংলাদেশ থেকে দেওয়া নৌকার একটি বিশালাকার মডেল। প্রদর্শনীর ভিতরে রয়েছে বহু ঐতিহাসিক ছবি এবং দুষ্প্রাপ্য নথির ছবি।


উদয়ন


রবীন্দ্র ভবন মিউজিয়াম শ্যামলী

রবীন্দ্রনাথের ব্যাবহৃত গাড়ি

মিউজিয়াম থেকে বেরিয়ে আমরা এগিয়ে চললাম মিউজিয়ামের পিছনের দিকে। মিউজিয়াম ভবনের ঠিক পিছনেই রয়েছে সাদা রঙের বিশালকার অট্টালিকা উদয়ন। উদয়ন কিন্তু কবিগুরুর ভাবনায় তৈরি নয়। কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই বাড়ি তৈরি করেন। উদয়ন থেকে একটু এগোতেই একটি ছোট্ট কাঁচের ঘরে সংরক্ষিত আছে কবির ব্যবহার করা গাড়িটি। তার পাশেই রয়েছে সম্পূর্ণ মাটির তৈরি বাড়ি শ্যামলী। শ্যামলীর পাশে রয়েছে প্রতীচী। এই বাড়িগুলিতে রবীন্দ্রনাথ বিভিন্ন সময় বসবাস করেছিলেন। এই সারা চত্ত্বরটার নাম উত্তরায়ণ। সারা প্রাঙ্গন জুড়ে রয়েছে সুন্দর করে সাজানো বাগান। শীতকালীন বিভিন্ন ফুলের রঙে সারা জায়গাটা রঙ্গীন। ইতিউতি ছড়িয়ে আছে রামকিঙ্কর বেজের হাতে তৈরি বিবিধ স্থাপত্য। সব দেখে যখন মিউজিয়াম থেকে বেরোলাম সূর্যদেব অনেকটাই পশ্চিমদিকে হেলে গেছেন।     

মিউজিয়ামের ঠিক উল্টোদিকে বিশ্বভারতীর প্রবেশদ্বার। এখানে আমরা একজন গাইডকে সঙ্গে নিয়ে নিলাম। সেই আমাদের সারা বিশ্বভারতী ঘুরিয়ে দেখাবে সঙ্গে বুঝিয়ে দেবে প্রত্যেক জায়গার ইতিহাসও। আমাদের বিশ্বভারতী দর্শন শুরু হলো শান্তিনিকেতন গৃহ দিয়ে। এটি শান্তিনিকেতনের প্রথম বাড়ি। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ এই গৃহ নির্মাণ করেন। রবীন্দ্রনাথ সহ ঠাকুর পরিবারের বিভিন্ন মানুষ এখানে বিভিন্ন সময় বসবাস করেছিলেন। দোতলা এই বাড়িটির মধ্যেও গড়ে উঠেছে সংগ্রহশালা। শান্তিনিকেতন গৃহের সামনেই রয়েছে রামকিঙ্কর বেজের এক স্থাপত্য যেটার উপর এক বিশেষ কোন থেকে যে ছায়াটি পরে তা দেখলে মনে হয় মা সন্তানকে কোলে জড়িয়ে ধরে আছে।



রামকিঙ্কর বেজের স্থাপত্য শান্তিনিকেতন গৃহ

শান্তিনিকেতন গৃহের ঠিক পাশেই উপাসনা গৃহ। এটির চারধার রঙিন বেলজিয়াম কাঁচ দিয়ে ঘেরা। প্রত্যেক বুধবার এখানে প্রার্থনা করা হয়। উপাসনা গৃহ থেকে একটু এগিয়ে গিয়ে পরে ছাতিমতলা। এখানে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ধ্যান করতেন। গেটের মাথায় লেখা 'তিনি আমার প্রাণের আরাম, মনের আনন্দ, আত্মার শান্তি'। আস্তে আস্তে এগিয়ে চললাম আম্রকুঞ্জের মধ্যে দিয়ে। খেলা আকাশের নীচে চারিদিকে ছড়িয়ে রয়েছে গোল গোল বেদী ঘেরা ক্লাসরুম গুলো। পথ চলতে চলতে এক এক করে দেখে নিলাম সিংহসদন, দেহলি শালবীথি .... কালোবাড়ি।



উপাসনা গৃহ আম্রকুঞ্জ


ছাতিম তলা দেহলি

মাটি ও আলকাতরা দিয়ে তৈরি এই কালোবাড়ি। সারা দেওয়াল জুড়ে রয়েছে বিভিন্ন রিলিফ ওয়ার্কের কাজ। নন্দলাল বসু এই কাজ শুরু করেন, তারপর বহু ছাত্রছাত্রী এই কাজ এগিয়ে নিয়ে যান। এবারে বিশ্বভারতীর ১৫০ বছর পূর্তি। সেই উপলক্ষে কালোবাড়ির সমানের মঞ্চে চলছিলো নৃত্যানুষ্ঠান। কিছুক্ষন সেই অনুষ্ঠান দেখে আমরা আবার এগিয়ে চললাম। সূর্যের আলো তখন নিবে গেছে। মায়াময় আলো আঁধারীর মধ্যে দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে একসময় কলাভবন, আর রামকিঙ্কর বেজের বিখ্যাত স্থাপত্য সাঁওতাল পরিবারের সমানে এসে উপস্থিত হলাম। এই মূর্তিটি উনি মাটি ছুঁড়ে ছুঁড়ে বানিয়ে ছিলেন। গাইড মশাই এখান থেকেই বিদায় নিলেন। আর আমরাও ধরলাম রিসর্টে ফেরার পথ। 



ঘন্টাতোরণ - সিংহ সদন সিংহ সদন

কালোবাড়ি

ফেরার পথে টোটোওলার সাথে কথা বলে রাখলাম পরেরদিনের sight seeing এর জন্য। বললো সকাল সাড়ে নটা নাগাদ ওরা এসে আমাদের নিয়ে বেরিয়ে পরবে। রিসর্টে ফিরে সবাই মিলে বসে পড়লাম আড্ডা মারতে। তবে সারাদিনের ক্লান্তির পর খুব বেশিক্ষণ চললো না সেই আড্ডা। খেয়েদেয়ে দশটার মধ্যেই শুয়ে পড়লাম আমরা। পরেরদিনও আমাদের অনেক ঘরাঘুরি আছে। তবে সে গল্প এই পর্বে নয় ..... পরের পর্বে।



-------------------------------------------------
সায়ন্তন বসু 
-------------------------------------------------





কিছু প্রয়োজনীয় তথ্য :
=======================================================================
আমাদের অস্থায়ী ঠিকানার নাম : Niribili Guest House
দুরাভাস : 9434122166
Website : http://niribiliguesthouse.com
ভাড়া : 600 টাকা প্রতিঘর প্রতিদিন

Comments

Post a Comment

Popular posts from this blog

সুন্দরবনের দুয়ারে ঝড়খালি (Jharkhali - Sundarban)

রামরাজাতলা (Ramrajatala - Howrah)