Shantiniketan (Part - 2)
কবিগুরুর দেশে তিনদিন (পর্ব - ২) - শান্তিনিকেতনের আশেপাশে
কবিগুরুর দেশে তিনদিন - বিশ্বভারতী পর্বের পর
পরেরদিন খুব সকালবেলা ঘুম ভাঙলো পাখিদের ঐক্যবদ্ধ কলতানে। বিছানা ছেড়ে বাইরে বেড়িয়ে এলাম। আগের দিনের ধকলের পর সবাই এখনও ঘুমের দেশে। পূব আকাশে তখন সবে আলো ফুটতে শুরু করেছে। পাশের বাগানটায় তখন প্রচুর পাখি এগাছ থেকে ওগাছে ওড়াউড়ি করছে। হাল্কা শীতের ভোরের স্নিগদ্ধতা মেখে তখন প্রকৃতি প্রস্তুত হচ্ছে আরও একটা সুন্দর দিনকে স্বাগত করার জন্য। এই সময়টা একা একা উপভোগ করতেই বেশি ভালো লাগে। তাই কাউকে আর বিরক্ত না করে চুপচাপ ঘুরতে থাকলাম বাগানের মধ্যে। একসময় পূব আকাশ রাঙিয়ে সূর্যদেব উদিত হলেন। এক এক করে অন্যরাও উঠে পড়লো।
শুরু হলো বেরোনোর প্রস্তুতি। সাড়ে নটার মধ্যেই সকলে lunch করে তৈরি হয়ে নিলাম। যেহেতু অনেকগুলো বাচ্ছা আছে তাই আমরা আগেরদিনই ঠিক করে রেখেছিলাম দুপুরের খাবার খেয়েই বেরোবো। আর দুপুরবেলা টুকটাক খেয়ে নেবো। এতে বাচ্চাদের খাওয়ানোর চিন্তাটা থাকবে না। সেইমত মাতু সকাল বেলাতেই ভাত বসিয়ে দিয়েছিলো। আর আগেরদিনের মাংস ছিলই তাই দিয়েই বেশ মাংস ভাত খাওয়া হয়ে গেলো। এরপর শুরু হলো আমাদের ফটোসেশন। বেশ কিছুক্ষন ধরে চললো নিজেদের ছবি তোলা। এর মধ্যেই আমাদের দুখানি বাহন এসে পড়লো।
সকাল দশটা নাগাদ আমরা যাত্রা শুরু করলাম কঙ্কালীতলার উদ্যেশ্যে। বীরভূমের যে পাঁচটি শক্তিপীঠ আছে তার মধ্যে একটি হলো কঙ্কালীতলা। সতীমায়ের কাঁখ পড়েছিল মন্দির সংলগ্ন জলাশয়ে। প্রান্তিক স্টেশন পেরিয়ে সুন্দর পিচ বাঁধানো রাস্তা দিয়ে এগিয়ে চললো আমাদের টোটো। দুপাশে দিগন্ত বিস্তৃত চাষের ক্ষেত। এখন ফসল কাটা হয়ে গেছে। প্রকৃতির রূপ উপভোগ করতে করতে একসময় আমরা এসে পৌঁছলাম কঙ্কালীতলায়।
অন্যান্য মন্দিরের মতই এই মন্দিরের যাওয়ার রাস্তার দুপাশে পুজোর উপকরণের পসারি নিয়ে বসে আছে দোকানিরা। মন্দির চত্বরটা পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। ভিতরে একটা বড় চাতালযুক্ত লাল রঙের মন্দির। এখানে মায়ের মূর্তি নয় ছবিকে পুজো করা হয়। যেহেতু আমরা ভাত খেয়ে বেড়িয়েছি তাই আমরা কেউ আর পুজো দিলাম না। মাকে প্রণাম করে পাশের গেট দিয়ে চলে এলাম সেই পবিত্র জলাশয় দেখতে যেখানে মায়ের কাঁখ পড়েছে। জলাশয়ের জল মাথায় ছিটিয়ে নিলাম। মন্দিরের পাশে এক বাউল বসে খুব সুন্দর গান করছিলেন। আরও বেশ কিছুক্ষণ বাউল গান শুনে আবার বেরিয়ে পড়লাম। পরের গন্তব্য সৃজনী।
কিন্তু সৃজনী যাবার পথে একটা বিপত্তি হলো। আমাদের টোটোটি মাঝরাস্তায় আর খেলবো না বলে দাঁড়িয়ে পড়লো। তবে আমাদের টোটোওয়ালা সাথে সাথে ফোন করে অন্য আরেকটা টোটোর ব্যবস্থা করে দিলো। কিন্তু তাও আমাদের প্রায় আধঘন্টা অপেক্ষা করতে হলো অন্য টোটোটা আসার জন্য। টোটোটা আসতে যাত্রা শুরু হলো।
ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের আদিবাসীদের গ্রাম্যজীবনকে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে এখানে। তারা যেমন বাড়িতে বসবাস করে সেইরকম করে বানানো হয়েছে বাড়ি। বাড়ির ভিতরে সুন্দর করে সাজানো আছে তাদের ব্যবহৃত জিনিসপত্র। এছাড়া এখানে রয়েছে একটা পুতুল ঘর। যেখানে বিভিন্ন প্রদেশের হাতে তৈরি পুতুল। এইরকম এক বাড়ির দাওয়ায় বসে এক বাউল গান গাইছিলেন। তাই সন্দীপদা আর থাকতে পারলো না, দোতারা নিয়ে বসে পড়লো তার সঙ্গে সঙ্গ দিতে। বেশ জমে গেলো দুজনের যুগলবন্দী।
স্থানীয় মানুষরদের হাতে তৈরি জিনিসের একটা ছোট্ট বাজার বসে এখানে। সেইখানে বেশ খানিক্ষণ ঘোরাঘুরি করে আবার সওয়ার হলাম টোটোতে। এবারে যাবো আমার কুটিরে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গ্রামোন্নয়নের কর্মপদ্ধতির আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে বিপলবী সুষেন মূখার্জ্জী কোপাই নদীর তীরে আমার কুটিরের প্রতিষ্ঠা করেন। গ্ৰামোন্নয়নের সাথে সাথে এইখানে স্বাধীনতা সংগ্রামীদেরও আশ্রয় দেওয়া হতো। সেই অপরাধে সুষেন মূখার্জ্জীকে কারাবাসও করতে হয়। সেসময় কিছুদিনের জন্য আমার কুটিরের কাজকর্ম বন্ধ থাকলেও পরে তা আবার চালু হয়। ভারতের স্বধীনতা সংগ্রামে এক বিশেষ ভূমিকা পালন করেছিলো এই প্রতিষ্ঠান। স্বধীনতার পরে এই প্রতিষ্ঠান এক গ্রামোন্নয়ন সমিতিতে পরিণত হয়। এখন এই প্রতিষ্ঠানের মূল লক্ষ্য গ্রামীণ কুটির শিল্পকে সকলের সামনে তুলে ধরা ও এগিয়ে নিয়ে যাওয়া।
সৃজনী থেকে আমার কুটির যাওয়ার রাস্তার অধিকাংশটাই সোনাঝুরির জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। দারুন লাগছিলো নির্জন রাস্তার মধ্যে দিয়ে চলতে। দুদিকে সোনাঝুরি সহ আরো বিভিন্ন গাছের সবুজের সমারোহ আর মাঝখান দিয়ে চলে গেছে সরু রাস্তা। এই শহুরে ক্লান্ত চোখদুটোকে যে কি আরাম দিচ্ছিলো তা লিখে বোঝানো সম্ভব নয়। অরণ্যের এই রূপ উপভোগ করতে করতে এক সময় আমরা পৌঁছে গেলাম আমার কুটিরে।
আমার কুটিরের প্রবেশদ্বারের সামনেই রয়েছে একটা বড় রবীন্দ্রনাথের মূর্তি। তার দুই পাশে রয়েছে দুটি বিপনন কেন্দ্র। এখানে স্থানীয় মানুষদের হাতে তৈরি বিভিন্ন হস্তশিল্প সামগ্রী সাজিয়ে রাখা আছে বিক্রির জন্য। আমরা আরো একটু এগিয়ে চলে এলাম একবারে কোপাই নদীর পারে। নির্জন জঙ্গলে উঁচু উঁচু গাছের ছায়ায় বসে বেশ কিছুক্ষণ কোপাই নদীর সৌন্দর্য উপভোগ করে ফিরে চললাম আমাদের টোটোর দিকে। এবার আমাদের গন্তব্য প্রকৃতি ভবন।
প্রকৃতি ভবনে যাবার পথেই পড়লো বুদ্ধ মন্দির। বিশালাকার বুদ্ধ মূর্তি নির্মাণ শেষ হয়ে গেলেও এখনো আশপাশের কাজ শেষ হয়নি। প্রকৃতিভবন হলো এক ভিন্ন ধরনের সংগ্রহশালা। এখানে বিভিন্ন ধরনের পাথর সংগ্ৰহ করা আছে। এই পাথরগুলির বৈশিষ্ট হলো এদের আকৃতির সঙ্গে কোনো না কোনো জাগতিক জিনিসের মিল আছে। তবে আমাদের দলের অধিকাংশ সদস্য বিশেষত বাচ্ছারা তখন মধ্যাহ্নের রোদের তেজে বেশ ক্লান্ত। তাই আমরা ঠিক করলাম আমরা আর প্রকৃতি মিউজিয়ামে ঢুকবো না। সেইমত টোটো আবার ছুটতে লাগলো পরবর্তী আর শেষ গন্তব্য খোয়াই এর হাটে।
খোয়াই এর হাট এখন শান্তিনিকেতনের এক অন্যতম আকর্ষণ হয়ে উঠেছে। প্রতি শনিবার স্থানীয় মানুষরা তাদের হস্তশিল্পের পসরা নিয়ে এসে জড়ো হন বিকিকিনির উদ্দেশ্যে। আমরা যখন হাটে পৌঁছলাম তখন হাট বেশ জমে গেছে। আমাদের সারথীরা আমাদের নাবিয়ে দিয়ে চলে গেলো। বললো যতক্ষন খুশি ঘুরুন ফেরার আধঘন্টা আগে ফোন করে দিলে ওরা চলে আসবে।
হাটে ঢুকতেই কানে এলো নুপুর আর মাদলের আওয়াজ। দৌড়ে গেলাম আওয়াজ লক্ষ্য করে। দেখলাম কয়েকজন আদিবাসী মানুষ মাদল বাজাচ্ছেন আর তার সাথে তালে তালে কয়েকজন আদিবাসী রমণী নাচ করছেন। পা যেন নিজের থেকেই আটকে গেল এখানে এসে। প্রকৃতির উন্মুক্ত প্রাঙ্গনে, অবাধ্য মন তখন আর নিজেকে বেঁধে রাখতে পারলো না। তথাকথিত শহুরে ভদ্রতার খোলস ছেড়ে আমাদের দলের মহিলা ও বাচ্ছারা একসময় এগিয়ে গিয়ে তাদের সাথে হাত মেলালো। আমরাও হাততালি দিতে থাকলাম মন মাতাল করা সেই আদিবাসী সঙ্গীতের সঙ্গে।
নাচ শেষ হওয়ার পর এবার হাট দেখার পালা। কিন্তু তার আগে একবার খোয়াইটা দেখে নেওয়া দরকার। হ্যাঁ, খোয়াই। খোয়াই এর হাটের কথা সবাই জানে কিন্তু খোয়াই এর কথা হয়ত অনেককেই জানেন না। এই হাটের একটু পিছনে গেলেই একটা canyon টাইপের জায়গা আছে। আমরা অনেকেই হয়ত গনগনির নাম শুনেছি। এটাও এই গনগনির মত একটা ক্ষয়িষ্ণু জায়গা। আর এই জায়গার থেকেই নাম হয়েছে খোয়াই। দলের সবাইকে নিয়ে গেলাম খোয়াই দেখতে। প্রকৃতি আপন খেয়ালে প্রথমে তৈরি করেছে গহীন খাদ। তারপর বৃষ্টি আর বাতাস তার উপর কারুকার্য করেছে। খাদের ভিতর থেকে উঁকি মারছে বড় বড় মহীরুহ।
খোয়াই দেখে আবার ফিরে এলাম হাটে। এ যেন handicraft এর এক বিশাল open air প্রদর্শনী। ঘর সাজানোর জিনিস, ছোটো ছোটো খেলনা, কাঠের জিনিস, বিভিন্ন মাপের ব্যাগ, চাদর কি নেই সেখানে। রয়েছে প্রচুর জামা কাপড়ের দোকান। আর দরদাম করতে পারলে দামও বেশ সস্তা। এই সব দোকানের মধ্যে ঘুরতে ঘুরতে মাঝে মাঝেই চোখে পড়লো কোথাও সাঁওতাল নৃত্য হচ্ছে… কোথাও বা বাউল গান গেয়ে চলেছে আপন খেয়ালে। আমরা প্রায় তিনঘন্টা ধরে ঘুরে ঘুরে হাট দেখলাম। সঙ্গে চললো কেনাকাটা আর পেটপুজোও।
এক সময় সুয্যিমামা ঢলে পড়লেন পশ্চিম আকাশে। আমরাও ফোন করলাম আমাদের সারথিদের। ওরা বললো পাশেই আছি আপনারা চলে আসুন। এবার রিসর্টে ফেরার পালা। আজ আমাদের শান্তিনিকেতনে শেষ রাত। তাই ক্লান্ত থাকা সত্ত্বেও সবাই মিলে অনেক রাত পর্যন্ত হাসিমজা করা হলো। রাত ফুরোলেই তো আবার সেই কর্মব্যস্ত জীবনে ফিরে যাওয়া... আবার সেই তথাকথিত শহুরে corporate culture এর খোলসে নিজেকে বন্দী করে ফেলা…
Comments
Post a Comment