তারাপীঠের আশেপাশে (পর্ব-১)
সময়টা May মাসের শেষের দিক। অনেক দিন কোথাও যাওয়া হয়নি। সামনে কোনো ছুটিও নেই। কিন্তু মন মুক্তি চাইছে দৈনন্দিন রুটিনের হাত থেকে। তাই ঠিক করলাম সপ্তাহান্তের ছুটিতে একদিনের জন্য বেরিয়ে আসি তারাপীঠ। হটাৎ সিদ্ধান্ত তার ওপর গরমের ছুটি irctc তে login করে দেখলাম, যা ভেবেছি তাই। AC Waiting List এর লাইন বেশ লম্বা। তবে 2nd class এ বেশ কিছু জায়গা এখনো আছে। সঙ্গে সঙ্গে গণদেবতা এক্সপ্রেসে আমাদের পাঁচ জনের পাঁচটা টিকিট কেটে নিলাম।
সেই মত এক শনিবার ভোরবেলায় আমরা সাড়ে চারজন চেপে বসলাম আমাদের সংরক্ষিত আসনে। ঠিক 6টা 05 মিনিটে ট্রেন ছেড়ে দিলো। আগের দিন রাত্রিবেলার কালবৈশাখীর কৃপায় সকালের আবহাওয়াটা বেশ মনোরম, গরমের আধিক্য একেবারেই নেই । ব্যান্ডেল, বর্ধমান, বোলপুর ছাড়িয়ে যখন আমরা রামপুরহাট স্টেশনে পৌঁছলাম ঘড়িতে তখন প্রায় 11টা।
হোটেলের check in time বেলা 12 টায়, হাতে বেশ খানিকটা সময় আছে। তাই স্টেশনেই জলখাবার খেয়ে নেবো ঠিক করা হলো। স্টেশনের গেটের উল্টো দিকেই দেখলাম রয়েছে সুন্দর একটি রেস্টুরেন্ট। এখানেই আমরা পুরী আর ডিম টোস্ট দিয়ে প্রাতরাশ সেরে নিলাম। এরপর দরদস্তুর করে একটা অটোতে করে যাত্রা করলাম তাড়াপীঠের উদ্দেশ্যে। সুন্দর রাস্তা আর গ্রাম্য পরিবেশের মধ্যে দিয়ে চলতে চলতে একসময় পেরিয়ে গেলাম তারাপীঠের বিশালাকার প্রবেশ তোরণ। আরো কিছুটা এগিয়ে এসে পৌঁছলাম আমাদের আজ রাতের অস্থায়ী ঠিকানা হোটেল তীর্থতে।
হোটেলটি বেশ ভালো। ঘরগুলিও বেশ বড় ও পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। হোটেলের নিজস্ব রেস্টুরেন্ট থেকে ঘরে খাবার দিয়ে যায়। খাবারের মান যথেষ্ট ভালো। আর হোটেল থেকে মন্দিরে যেতে হাঁটা পথে বড়জোর 10 মিনিট।
ঘরে ঢুকেই ফ্রেশ হয়ে lunch সেরে নিলাম। এরপর একটু বিশ্রাম। বিকালে রোদের তেজ একটু কমতে আবার বেড়িয়ে পরা হলো তারাপীঠের আশপাশের দ্রষ্টব্যগুলো দেখে নিতে। হোটেলের গেটের সামনে থেকেই একটা টোটো ভাড়া করে নেওয়া হলো।
সুন্দর গ্রাম্য পথের মধ্যে দিয়ে ছুটে চললো আমাদের টোটো, উদ্দেশ্য আটলা গ্রাম। সাধক বামাখ্যাপার জন্মভিটে রয়েছে এই গ্রামে। প্রায় আধঘন্টা চলার পর আমরা পৌঁছলাম বাবার জন্মভিটেতে।
তারাপীঠের সর্বাধিক প্রসিদ্ধ সাধক হলেন বামাক্ষ্যাপা। তিনি ছিলেন তারামায়ের একনিষ্ঠ ভক্ত। তিনি মন্দিরে পূজা করতেন এবং শ্মশানে সাধনা করতেন। তিনি মন্দিরের নিয়ম মানতেন না। শোনা যায়, এরপর তারাদেবী নাটোরের ম্হারানিকে স্বপ্নাদেশ দেন দেবীর পুত্র বামাক্ষ্যাপাকে প্রথমে ভোজন করাতে হবে। এরপর থেকে মন্দিরে দেবীকে নৈবেদ্য নিবেদনের পূর্বে বামাক্ষ্যাপাকে ভোজন করানো হত এবং কেউ তাঁকে বাধা দিতেন না।
কিন্তু আটলায় পৌঁছানোর পর এক অদ্ভুত সমস্যার সম্মুখীন হলাম। পাশাপাশি দুটি বাড়ি। দুটি বাড়িতেই লেখা আছে এই বাড়ি বামাখ্যাপার আসল জন্মভিটে। পরে জানলাম দুটি বাড়িতেই বাবার বংশধরেরা থাকেন। আর তাদের বিবাদের জেরে এই ঘটনা। দুজনেরই দাবি বাবার জন্মস্থান তাদের বাড়িতে। সর্বত্যাগী বাবার বংশধরদের এহেন বৈষয়িক বিবাদ সত্যি বড় বেমানান। শুধু তাই নয় বাবার ভক্ত থেকে সাধারণ পর্যটক সকলের কাছে বড় দৃষ্টিকটু লাগে এই ঘটনা।
যাই হোক সত্যমিথ্যা যাচাইয়ের উপায় বা ইচ্ছা কোনোটিই না থাকায়, দুটি মন্দিরেই প্রবেশ করলাম। দুজায়গাতেই রয়েছে বাবার মূর্তি। মাটির একটি ঘরকে সাজিয়ে রাখা হয়েছে বাবার জন্মকক্ষ হিসাবে। আমরা বাবার মূর্তিতে প্রণাম করে আবার টোটোতে উঠে বসলাম।
পরবর্তী গন্তব্য সঙ্কটমোচন মন্দির। সঙ্কটমোচন মন্দিরে যখন পৌঁছলাম তখন সন্ধ্যা অতিক্রান্ত। নব নির্মিত এই মন্দিরের ছাদটা আসলে এক বিশাল শিবলিঙ্গ। ভিতরে রয়েছে বজরংবলীর বিশালাকার মূর্তি। সঙ্গে আরও দেবদেবীর মূর্তি। কিন্তু মন্দিরটি নতুন তৈরি হচ্ছে বলে বোধহয় এখনো ঠিক মত আলোর ব্যবস্থা করা হয়নি।
সঙ্কটমোচনকে প্রণাম জানিয়ে আমরা রওনা দিলাম ছিন্নমস্তা মন্দির দেখতে। তারামায়ের গলি পেরিয়ে বেশ খানিকটা যাওয়ার পর এক অন্ধকার গলির সামনে টোটো দাঁড় করিয়ে সারথী বললো এই গলির ভিতরই নাকি মায়ের মন্দির। মোবাইলের টর্চ জেলে সেই রাস্তা দিয়ে বেশ কিছুটা যাওয়ার পর পৌঁছলাম ছিন্নমস্তা মন্দিরে। রাতেরবেলা মন্দির প্রাঙ্গন একেবারে খালি। শুধু আমরাই পাঁচজন দর্শনার্থী। তাই খুব সুন্দর ভাবে দর্শন হলো মায়ের। গেট দিয়ে ঢুকে বেশ খানিকটা হেঁটে গিয়ে, ডানহাতে সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে, দোতলায় মায়ের মন্দির। ভিতরে মায়ের মূর্তি। ভিড় না থাকায় বেশ সুন্দর ভাবে দর্শন হলো মায়ের। দেখলাম মন্দির সংলগ্ন আশ্রমে রয়েছে থাকার সুন্দর ব্যবস্থা।
ছিন্নমস্তা মন্দির থেকে বেরিয়ে আমরা চললাম মুন্ডমালিনী কালী মন্দির। তারা মায়ের গলির ঠিক বিপরীত গলিতে কিছুদূর গেলে শান্ত নিরিবিলি পরিবেশে শ্বেত পাথরে বাঁধানো মায়ের মন্দির। সিঁড়ি দিয়ে কয়েক ধাপ উঠে মায়ের মন্দির। সামনে রয়েছে একটা নাটমন্দিরও। অপূর্ব সুন্দর মাতৃমূর্তি।
![]() |
মা মুন্ডমালিনী |
তারা মা এখানে নীল সরস্বতী রূপে পূজিতা হন। কথিত আছে মা এই স্থানে তার মুন্ডমালা খুলে রেখে অবগাহন করতে যেতেন। পরে এই মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা ছোটোবাবাকে স্বপ্নাদেশ দেন এইস্থানে মন্দির স্থাপনের জন্য। সেইমত ছোটবাবা এখানে আশ্রম ও মায়ের মন্দির স্থাপন করেন। মায়ের মন্দিরের লাগোয়া ছোটবাবার মন্দিরও আছে। মুন্ডমালিনী মায়ের দর্শন করে আমরা এগিয়ে চললাম আজকের শেষ দ্রষ্টব্য ভারত সেবাশ্রম সংঘের উদ্দেশ্যে।
খুব সুন্দর করে সাজানো এই মন্দির। বিশালাকার গেট পেরিয়ে বেশ কিছুটা এগিয়ে গিয়ে কয়েক ধাপ সিঁড়ি উঠে একটা বড় চাতাল রয়েছে। চাতালের একপাশে মুলপ্রবেশ দ্বারের ঠিক বিপরীতে রয়েছে রথে আসীন কৃষ্ণার্জুন মূর্তি। মূল প্রবেশদ্বার দিয়ে প্রবেশ করলে এক বিশাল প্রার্থনা কক্ষ। প্রবেশদ্বারের দুইপাশে দুটি কাঠের হাতি রাখা আছে। আর সোজাসুজি রয়েছে প্রণবানন্দজীর বিশাল ছবি। আমরা যখন পৌঁছালাম তখন ঢাক বাজিয়ে মহারাজের আরতি শুরু হয়েছে। প্রার্থনা কক্ষের দুই পাশে রয়েছে দুটি কাঁচের মন্দির একটিতে আসীন প্রণবানন্দজী অন্যটিতে শিবের মূর্তি।
দরজার পাশ দিয়ে রয়েছে নীচে যাবার সিঁড়ি। সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে অভিভূত হয়ে গেলাম। বিশাল হলটির মাঝখানে রয়েছে সখি পরিবেষ্টিত সুন্দর রাধাকৃষ্ণের মূর্তি। সারা হলের দেওয়াল এ চিত্রিত আছে বিষ্ণুর বিভিন্ন অবতারের ছবি। মন ভরে গেল মন্দিরটা দেখে।
ফেরার পথে নেমে পড়লাম তারামায়ের গলির মুখে। মন্দিরের গলির ঠিক মুখেই রয়েছে সারিসারি তেলেভাজার দোকান। হরেক রকমের চপ আর তেলেভাজা পাওয়া যায় সেখানে। আমরা বেশ কয়েক রকমের চপ আর পাকোড়া খেলাম। তারপর মন্দিরের গলির ভিতর ঢুকে প্রথমে গেলাম আমাদের পান্ডা ঠাকুরের সাথে সাক্ষাৎ করতে। কারণ পরের দিন ভোরবেলা আমরা পুজো দেবো। তাই আগে থেকে কথা বলে রাখা দরকার। পান্ডা ঠাকুরের দোকানে গিয়ে কথা বলে নিলাম। উনি বললেন পরদিন সাতটার মধ্যে চলে আসতে।
ফেরার পথে মন্দিরের গলিতে একটা দোকানে দেখলাম টাটকা প্যাঁড়া তৈরি হচ্ছে। সেখান থেকে প্যাঁড়া কিনে হোটেলে ফিরে এলাম। আজকে সকলেই খুব ক্লান্ত। তারপর পরেরদিন ভোরবেলা আছে পুজো দেওয়া। অতএব তাড়াতাড়ি রাতের খাবার খেয়ে শুয়ে পরা হলো।
ফেরার পথে মন্দিরের গলিতে একটা দোকানে দেখলাম টাটকা প্যাঁড়া তৈরি হচ্ছে। সেখান থেকে প্যাঁড়া কিনে হোটেলে ফিরে এলাম। আজকে সকলেই খুব ক্লান্ত। তারপর পরেরদিন ভোরবেলা আছে পুজো দেওয়া। অতএব তাড়াতাড়ি রাতের খাবার খেয়ে শুয়ে পরা হলো।
পরবর্তী পর্বে ফিরে আসবো তারাময়ের কথা নিয়ে ( সিদ্ধপীঠ তারাপীঠ )।
কিছু প্রয়োজনীয় বিষয়
===================
===================
১. রামপুরহাট থেকে তারাপীঠের অটো ভাড়া 250 টাকা। কিন্তু বেশ দরদস্তুর করতে হয়। ফেরার সময় এই ভাড়াটাই 150 টাকা হয়ে যায়।
২. Hotel Tirtho - AC DELUX ROOM এর ভাড়া 2000 টাকা। ফোন নং : (03461) 253215, Check in time সকাল 12টা।
এখানে বলে রাখা দরকার আমাদের ফেরার টিকিট ছিলো রামপুরহাট এক্সপ্রেসে বিকাল 4:30 তে। তাই আমরা ম্যানেজারকে অনুরোধ করে ছিলাম যদি check out time টা পরেরদিন বিকাল 4টে অবধি করা যায়। উনি আমাদের সেই অনুরোধ রেখেছিলেন এবং তার জন্য কোনো অতিরিক্ত charge নেননি।
৩. হোটেলের খাবার মান খুবই ভালো। আগে থেকে অর্ডার দিয়ে রাখতে হয়।
৪. পান্ডা না থাকলে বললে হোটেল থেকেই পান্ডা ঠিক করে দেয়।
৫. তারাপীঠের আশেপাশের দ্রষ্টব্যগুলি ঘুরে দেখার জন্য আমরা যে টোটো ভাড়া করেছিলাম সে 250 টাকা নিয়েছিল। সময় লেগেছিল প্রায় সাড়ে তিন ঘন্টা মত।
৬. এই সব জায়গাগুলিতে আলোর খুব অভাব তাই এগুলি সূর্য্যের আলো থাকতে থাকতে দেখে নেওয়া ভালো।
==========================
সায়ন্তন বসু
==========================
Comments
Post a Comment