সিদ্ধপীঠ তারাপীঠ (পর্ব - ২)

প্রথম পর্বের ( তারাপীঠের আশেপাশে ) পর ---



পরদিন সকাল সকাল উঠে স্নান করে তৈরি হয়ে নিলাম মন্দিরে যাওয়ার জন্য। আমাদের হোটেল থেকে মন্দিরের দূরত্ব বেশি নয়। তাই আমরা পায়ে হেঁটেই এগিয়ে চললাম মন্দিরের দিকে।
দ্বারকা নদী

আমাদের হোটেলটি দ্বারকা নদীর যে পাশে, মন্দির তার বিপরীত পাশে। তাই মন্দিরে যেতে হলে দ্বারকা নদীর উপরকার সেতু অতিক্রম করে যেতে হয়। নদী এখানে খুবই শীর্ণকায়। তবে ব্রিজের উপর দিয়ে খুব সুন্দর একটা ভিউ পাওয়া যায়।

ব্রীজ পেরোলেই মন্দিরের গলি। এই সকাল বেলাতেও দর্শনার্থী, পাণ্ডা ও দোকানদারদের ডাকাডাকিতে বেশ জমজমাট। এই ভিড় কাটিয়ে এগোতে এগোতে একসময় আমরা পান্ডাঠাকুরের দোকানে পৌঁছে গেলাম। ঘড়িতে তখন পৌনে সাতটা। আমাদের নাম গোত্র লিখে নিয়ে সেইমতো ডালা তৈরি করে দিলেন দোকানদার। ডালা নিয়ে দাঁড়ালাম পুজো দেবার লাইনে।

তারাপীঠ মন্দিরের প্রবেশদ্বার

তারা মায়ের মন্দির নিয়ে অনেক রকম পৌরাণিক কথা শোনা যায়। একটি মত অনুযায়ী দেবীর তৃতীয় নয়ন পরেছে এইখানে। তাই এটি শক্তিপীঠ। আবার অন্য একটি মতে সমুদ্রোমন্থনের সময় মহাদেব যে গড়ল পান করেন তা খেয়ে তাঁর গলায় খুব জ্বলনের সৃষ্টি হয়। সেই সময় তারামা তাঁকে স্তনপান করিয়ে সেই জ্বলন দূর করেন।

আরেকটি মতে বশিষ্ট মুনী বহুদিন ধরে তারামায়ের তপস্যা করছিলেন, কিন্তু তিনি বারবার ব্যর্থ হচ্ছিলেন। অবশেষে একদিন এক দৈববাণীর হয় এবং তাঁকে নির্দেশ দেওয়া হয় বিষ্ণুর আরেক অবতার বুদ্ধদেবের সঙ্গে দেখা করার জন্য। সেইমত তিনি তিব্বতে বুদ্ধদেবের সঙ্গে দেখা করেন।  বুদ্ধদেব দিব্যদৃষ্টির মাধ্যমে তারাপীঠ ও তারামায়ের স্তন পানরত শিবের মূর্তি দেখতে পান। বুদ্ধদেব বশিষ্ট মুনীকে তারাপীঠে গিয়ে সাধনা করতে বলেন। বুদ্ধদেবের নির্দেশ মত বশিষ্ট মুনী তারাপীঠে এসে বামহাতে ও কয়েকটি নিষিদ্ধ জিনিস দিয়ে মায়ের আরাধনা শুরু করেন। অবশেষে মা সন্তুষ্ট হন এবং বশিষ্ট মুনির অনুরোধ মত তাঁকে বুদ্ধদেবের দেখা মূর্তিরূপে দর্শন দেন ও সাথে সাথে প্রস্তুরীভূত হয়ে যান। সেই থেকে এখানে তারমায়ের পুজো শুরু হয়।  

আবার ফিরি আমাদের কথায়। একে রবিবার তার ওপর গরমের ছুটি। খুব ধীরে ধীরে এগোতে থাকলো লাইন। আমরাও তারা মন্দির দর্শন করতে করতে এগিয়ে চললাম।

লাল রঙের ইঁট দিয়ে তৈরি মন্দির। উপরে বিশালাকার রুপোলি রঙের গম্বুজ। ভিতরে রয়েছে শিবকে স্তন্যপানরতা তারার মূল প্রস্তরমূর্তিটি। এটি একটি উঁচু ধাতব মূর্তির মধ্যে রাখা থাকে। আমরা সাধারণত এই ধাতব মূর্তিটিই দর্শন করে থাকি। মন্দিরের গায়ে খোদাই করা রয়েছে বাঙলার প্রাচীন টেরাকোটা শিল্প। ফুটিয়ে তোলা হয়েছে রামায়ণ মহাভারতের বিভিন্ন উপাখ্যান। মন্দিরের সামনে রয়েছে নাটমন্দির। পুজো দেওয়ার না থাকলে এখান থেকেই দর্শন করতে হয় মাকে।


VIP লাইন হওয়া সত্ত্বেও গর্ভগৃহে প্রবেশ করতে প্রায় দেরঘন্টা লেগে গেল। গর্ভগৃহে প্রবেশদ্বারের ডান পাশে রয়েছে পিতলের তৈরি মায়ের চরণপদ্ম। ওখানে ফুল ও আলতা দিয়ে পুজো দেওয়ার রীতি। মায়ের গর্ভগৃহটি কিন্তু খুবই অপরিসর। তাই প্রচন্ড ভিড় থাকার জন্য খুব স্বল্প সময়ের মধ্যে মাকে দর্শন করতে হলো। কিন্তু মাকে একদম ছুঁয়ে প্রণাম করালেন আমাদের পান্ডাঠাকুর। মাকে প্রণাম জানিয়ে আমরা গর্ভগৃহের বাইরে বেরিয়ে এলাম।

মায়ের মন্দিরের বাইরেই রয়েছে শিবমন্দির। বাবা এখানে চন্দ্রচুর মহাদেব হিসাবে পূজিত হন। কথিত আছে মায়ের পুজো দিয়ে বাবার পুজো না দেওয়া পর্যন্ত মায়ের পুজো সম্পূর্ণ হয় না। সেইমত আমরাও বাবার মন্দিরে ঢুকে পুজো দিলাম। পুজো শেষে এগিয়ে চললাম পাশের মন্দিরের দিকে।

চন্দ্রচুর মহাদেবের মন্দিরের পাশেই রয়েছে সঙ্কটমোচন মন্দির। তারপর সিঁড়ি নেবে গেছে মন্দির লাগোয়া জীবিতকুন্ড সরোবরে। প্রবিত্র এই সরোবরের জলে স্নান করলে হয় সর্ব রোগের উপশম। বিশাল এই জলাশয়ের মধ্যে বেশ কিছু হাঁস আপনমনে ভেসে বেড়াচ্ছে। বহুমানুস পুন্যলাভের আশায় সরোবরের জলে স্নান করছেন। আমরাও সরোবরের জল মাথায় ছিটিয়ে নিলাম। তারপর সরোবরের পাশে নির্দিস্টস্থানে ধুপ জ্বালিয়ে মাকে আরেকবার নিজেদের মত করে পুজো করলাম।

পুজো পর্ব শেষ করে ফিরে এলাম দোকানে। ওখানে আমাদের প্রসাদগুলো প্যাক করে দিয়ে দেওয়া হলো। আর দোকানদারই বললেন বেলার দিকে এসে মায়ের ভোগপ্রসাদ নিয়ে যেতে। আমরা দোকান থেকে বেরিয়ে পড়লাম।

আস্তে আস্তে এগিয়ে চললাম বাজারের মধ্যে দিয়ে। পুজোর সামগ্রী, তারামায়ের ছবি ও তারামায়ের ছবি দেওয়া বিবিধ উপহার সামগ্রী, প্যাঁড়ার দোকান, আচারের দোকান, কাঠের পুতুলের দোকান এই সব দেখতে দেখতে আমরা ঢুকে পড়লাম একটি খাবারের দোকানে।
মন্দিরে যাওয়ার রাস্তা

বেলা অনেক হয়েছে সকাল থেকে পেটে কিছু পরেনি। এখানেও পুরী দিয়ে প্রাতরাশ সম্পন্ন করলাম সঙ্গে তারাপীঠের বিখ্যাত ল্যাংচা। এই ল্যাংচার খ্যাতি এর size আর স্বাদের জন্য। আধ হাত লম্বা ল্যাংচাও আছে দেখলাম। আমরা অবশ্য মাঝামাঝি মাপের ল্যাংচা নিলাম একটা করে।
তারাপীঠের বিখ্যাত ল্যাংচা

প্রাতরাশ শেষ করে ফিরে এলাম হোটলে। কিছুক্ষনের বিশ্রাম। মাঝে এক ফাঁকে গিয়ে মায়ের অন্ন ভোগ নিয়ে এলাম। এরপর দুপুরের খাওয়া সেরে বেরিয়ে পরলাম রামপুরহাট স্টেশনের উদ্দেশ্যে।এবার ঘরে ফেরার পালা।

তারাপীঠের মন্দিরের কিছু প্রয়োজনীয় তথ্য
===============================

১. তারাপীঠে বিকাল বেলা বা রাত্রিবেলা পুজো দেওয়াটা বেশি ভালো। কারণ ওই সময় ভিড় অনেক কম থাকে।

২. মায়ের কাছে পুজো দেবার অনেক রকমের লাইন আছে। সম্পূর্ণ বিনাপয়সা থেকে শুরু করে 100 / 300 / 500 / 1000 / 1500 টাকার VIP লাইন হয়।

৩. এখানে আপনার ইচ্ছা মত আপনি 21 টাকা থেকে শুরু করে যত খুশি মূল্যের পুজো দিতে পারেন। পান্ডাঠকুরের দক্ষিণা আলাদা।

৪. ভোগের জন্য আলাদা করে পান্ডাঠকুরের সাথে কথা বলে নিতে পারেন। আমাদের এর জন্য আলাদা কোনো মূল্য দিতে হয় নি।



Comments

Popular posts from this blog

সুন্দরবনের দুয়ারে ঝড়খালি (Jharkhali - Sundarban)

রামরাজাতলা (Ramrajatala - Howrah)

কবিগুরুর দেশে তিনদিন ( পর্ব - ১ ) - বিশ্বভারতী